Wednesday, January 15, 2025

দ্বাদশ বাংলা সাহিত্য

১.ফলিত ভাষাবিজ্ঞান কী? এর বিভিন্ন শাখার উল্লেখ করে যেকোনো একটি বিভাগের আলোচনা করে। ১+২+২=৫

উঃ ভাষাবিজ্ঞানের যে আলোচনাক্ষেত্রে ভাষার সঙ্গে সমাজের তথ অন্যান্য বিদ্যাচর্চার পারস্পরিক সম্পর্কের বিচার ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং সেইসব ক্ষেত্রে ভাষার অবদান বা প্রয়োগ আলোচিত হয়, তাকে ফলিত ভাষাবিজ্ঞান বলে।

ফলিত ভাষাবিজ্ঞানের শাখাগুলি: 

a. সমাজভাষাবিজ্ঞান

b. মনোভাষাবিজ্ঞান

c. স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান

d. নৃভাষাবিজ্ঞান

e. শৈলীবিজ্ঞান

e. অভিধানবিজ্ঞান... ইত্যাদি।


■ মনোভাষাবিজ্ঞান:

ভাষাবিজ্ঞানের যে বিভাগে ভাষার সঙ্গে মানবমনের সম্পর্ক আলোচিত হয়, তাই মনোভাষাবিজ্ঞান। এর প্রধান আলোচ্য বিষয় শিশুর ভাষাশিক্ষা।

মানবশিশু তার চারপাশের  পরিবেশ থেকে অনুকরণের মাধ্যমেই ভাষা শেখে । দীর্ঘদিনের এই বিশ্বাস নস্যাৎ করে আমেরিকার দার্শনিক তথা ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি ১৯৬০ সালে বললেন মানুষের মস্তিষ্কই ভাষা শেখার যন্ত্র (Language acqisition device-LAD)।

পরে তিনি একে  বলেন ভাষা শেখার  ব্যবস্থা (Language acqisition system-LAS)। মানবমস্তিষ্কে পূর্ব থেকেই উপস্থিত এক সর্বজনীন ব্যাকরণ আছে বলে তিনি মনে করেন যা শিশুকে এই LAD-LAS এর মাধ্যমে অনুকরণধর্মিতা থেকে সৃজনশীলতায় নিয়ে যায়।

মনোগত স্মৃতি, বৃদ্ধি, উদ্বেগ প্রভৃতি যে ভাষাগত সমস্যার মূলে থাকে এবং মানুষের ভাষাগত ভুল যে অনেকাংশেই মানসিক সমস্যার কারণে ঘটে থাকে, মনোভাষাবিজ্ঞান সেই তথ্যও জানায়।

■  শৈলীবিজ্ঞান :-

 ভাষা মনের ভাব প্রকাশক ব্যবস্থা হলেও তা ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর বিশিষ্টতা লক্ষ্যণীয়। ভাষার এই প্রয়োগজনিত বিশিষ্টতা ও তার বিশ্লেষণকে ফলিতভাষাবিজ্ঞান শৈলীবিজ্ঞান নাম দিয়েছে। শৈলীবিজ্ঞানের নিরিখ হল প্রয়োগনির্ভর। অর্থাৎ কোনো পাঠ্যবস্তুব লিখনবীতিই একমাত্র বিচার্য। স্যামুয়েল ওয়েসলি একেই বলেছেন "চিন্তার পোশাক" (The dress of thought)।


শৈলীবিচার মূলত দুইরকম:

১) মূল্যায়নভিত্তিক, উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার শৈলীর পার্থক

২) বর্ণনামূলক, উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের "চোখের বালি" উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর" শেষের কবিতা"- উপন্যাসের শৈলর পার্থক্য।


২. শব্দার্থের উপাদানমূলক তত্ত্বটি আলোচনা করো।

শব্দ হল কিছু উপাদানের সমষ্টি। এই উপাদানগুলিকে শব্দার্থ উপাদান বলা হয়। উপাদানমূলক তত্ত্বানুসারে শব্দের অর্থ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শব্দের অর্থকে বিশ্লেষণ করে ক্ষুদ্র উপাদানগুলিকে বের করতে হয়। এই উপাদানের ওপর ভিত্তি করে শব্দগুলিকে কিছু স্বাভাবিক শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে-

পুরুষ : নারী: শিশু

পুরুষ, নারী এবং শিশু- এই তিনটি শব্দই মানুষকে বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ, এই তিনটি শব্দেই যে শব্দার্থ উপাদানটি রয়েছে সেটি হল- মানবজাতীয়। আবার, পুরুষ এবং নারী শব্দদুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বোঝায় কিন্তু শিশু বলতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বোঝানো হয়। তাছাড়া, পুরুষ বলতে বোঝায় পুরুষজাতীয় মানুষ, নারী বলতে বোঝায় স্ত্রীলোক এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিকরণ প্রযোজ্য নয়।
এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে, 'পুরুষ', 'নারী' এবং 'শিশু' এই তিনটি শব্দ তিনরকম শব্দার্থ উপাদানের সমষ্টি। সেগুলি হল- প্রজাতিগত (মানব), বয়সগত (প্রাপ্তবয়স্ক অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক) এবং লিঙ্গগত (স্ত্রী, পুরুষ ইত্যাদি)।

সীমাবদ্ধতা: উপাদান মূলক তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা ও আছে। যেমন-
১. এই তত্ত্ব সব ধরনের শব্দের ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ নয়।
২. এর উপাদান গুলি অনেকটা নতুন শব্দের মতো। তাদেরও অর্থ উপাদান থাকা উচিত।
 ৩.তাছাড়া বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য সর্বজনবিদিত অর্থ উপাদান বিরল।
    এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শব্দের সাধারণ শ্রেণী নির্ধারণ ও বিন্যাসের আলোচনায় এই তত্ত্ব বিশেষ উপযোগী।



৩. বিভাজ্য ও অবিভাজ্য ধ্বনি বিষয়টি উদাহরন সহ আলোচনা করো ।

ধ্বনি প্রাথমিক ভাবে দুই প্রকার: বিভাজ্য ধ্বনি ও অবিভাজ্য ধ্বনি।

বিভাজ্য ধ্বনি: যে ধ্বনিকে আলাদা করে ভেঙে দেখানো যায়, তাকে বিভাজ্য ধ্বনি বলে।

যেমন: কমল = ক্‌+অ+ম্+অ+ল্ + অ।

এখানে দেখা যাচ্ছে 'কমল' শব্দটিকে ভাঙলে ছটি ধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। এই ছটি ধ্বনি বিভাজ্য ধ্বনির উদাহরণ। সমস্ত স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনিই বিভাজ্য ধ্বনি।

বিভাজ্য ধ্বনি দুই প্রকার: স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি।

বিভাজ্য ধ্বনিগুলি পাশাপাশি বসে ধ্বনিগুচ্ছ গঠন করে। এই ধ্বনিগুচ্ছ যখন অর্থ বহন করে, তখন তৈরি হয় শব্দ।

অবিভাজ্য ধ্বনি: যে ধ্বনিকে বিভাজ্য ধ্বনির মতো আলাদা করে দেখানো যায় না, তাকে অবিভাজ্য ধ্বনি বলে। যেমন সুর, দৈর্ঘ্য, যতি প্রভৃতি। অবিভাজ্য ধ্বনি বিভাজ্য ধ্বনির মতো পরিস্ফুট নয়।



4. উদাহরন সহ ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি বিষয়টি আলোচনা করো।

উ:- প্রতিবেশ বিশেষে একটি ধ্বনির উচ্চারণবৈচিত্র্য-সহ মূল ধ্বনিটিকে ধ্বনিমূল বলে। অর্থাৎ একই ধ্বনির উচ্চারণ এক-এক শব্দে এক-এক রমকের হতে পারে। 

আবার একটি ধ্বনিমূলের উচ্চারণ বিভিন্ন শব্দে যে আলাদা রকমের হয়, সেই আলাদা রকমের উচ্চারণকে বলে সহধ্বনি। সহধ্বনিকে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখতে হয়। স্বাভাবিক উচ্চারণ স্থানের সহধ্বনিকে [ল্] – এইভাবে লেখা হয়। 

যেমন-লম্বা, পল্টু, চালতা-এই তিনটি শব্দে 'ল' হল ধ্বনিমূল, কিন্তু তিনটি শব্দের 'ল্' উচ্চারণ একরকমের নয়। তিনটি শব্দের 'ল্' নিজের নির্দিষ্ট প্রতিবেশে উচ্চারিত হয়, একটির স্থানে অন্যটি উচ্চারিত হয় না।

ধ্বনিমূল ও সহধ্বনির সম্পর্ক

১) একটি ধ্বনিমূল যেন একটি ধ্বনিপরিবার এবং সহধ্বনিগুলি সেই পরিবারের সদস্য। একই পরিবারের সদস্য হতে গেলে দুটি শর্তপূরণ করতে হয়। প্রথমত, তাদের মধ্যে উচ্চারণগত সাদৃশ্য থাকা দরকার। দ্বিতীয়ত, সহধ্বনিগুলি একটির বদলে অন্যটি উচ্চারিত হবে না অর্থাৎ উচ্চারণগত অবস্থানের দিক থেকে তাদের পরস্পরের পরিপূরক হতে হবে। 

২) ধ্বনিমূল হল কল্পনা, আর সহধ্বনি তার বাস্তব রূপ ।বাস্তবে 'ল্'-এর কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এর তিনটি সহধ্বনি আমরা সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি।

৩) ধ্বনিমূল ভাষায় অর্থের পার্থক্য আনে, কিন্তু সহধ্বনি অর্থের তফাত করতে পারে না। যেমন –'দান' ও 'দাম' শব্দে 'ন' ও 'ম্' ধ্বনিমূল দুটি শব্দে অর্থ-পার্থক্য ঘটিয়েছে আর সহধ্বনি এদের অর্থ বদলায়নি।


5. বিজ্ঞান চর্চায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান আলোচনা করো ।

উ:- যে সমস্ত ভারতীয় বিজ্ঞানী দেশীয় বিজ্ঞান চর্চার উন্নতির  জন্য নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন। তাদের মধ্যে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় অন্যতম।  তিনি ছিলেন সহজ সরল এবং সাদাসিধে একজন বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি সমাজের উন্নতির জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়ে গেছেন। আজীবন চেষ্টা করেছেন দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য। 

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট বাংলাদেশের খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পিতা ছিলেন হরিশচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন তখনকার দিনের জমিদার এবং মহা পন্ডিত ব্যক্তি।প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী।



প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল গ্রামেরই এক ছোট স্কুলে। গ্রামের বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তারা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন পরবর্তী পড়াশোনার জন্য। কলকাতা এসে পিতা হরিশচন্দ্র রায় তার পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করেন।হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন। সেখানকার পড়াশুনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ২৭ বছর অধ্যাপনা করেন। অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য ক্রমেই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে স্বনামধন্য অধ্যাপক হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বিজ্ঞান সাধনায় তার কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে সি.আই.ই উপাধি প্রদান করে। পরে তিনি নাইট উপাধিও পান।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রসায়নবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তার বিখ্যাত আবিস্কারটি হল মারকিউরাস নাইট্রাইট। বাংলায় একে রস সিঁদুর ও বলা হয়ে থাকে।

ভারতবর্ষের অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্রের ছাত্র। তার কাছে গবেষণা করে অনেকেই বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী হতে পেরেছেন। মেঘনাথ সাহা সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, পুলিনবিহারী সরকার এরা ছিলেন তার বিখ্যাত সব ছাত্র।

বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি তার স্বপ্ন ছিল এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেখানে দেশবাসীরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। তার সাথে বিদেশি পণ্য ত্যাগ করে স্বদেশী পণ্যের দিকে মানুষ আকৃষ্ট হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যাল নামক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যেটি আজও সুনামের সাথে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে চলেছে।

প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন পুঁথি থেকে একটি অসাধারন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বইটির নাম দিয়েছিলেন "হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি” এই বইতে তিনি লিখে গেছেন প্রাচীন ভারত বিজ্ঞান চর্চায় কতটা উন্নত ছিল।

No comments:

Post a Comment