Showing posts with label B.A. Show all posts
Showing posts with label B.A. Show all posts

Monday, December 30, 2024

B.A CBPBU 1st Sem Minor 1 Bengali Question

B.A CBPBU 1st Sem Minor 1 Bengali Question 

1. চর্যাপদ কে কোথা থেকে কত সালে আবিস্কার করেন ? চর্যাপদের আবিস্কার কাল , ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করো । চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য আলোচনা করো । 2+3+5 ***

Ans:- বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম গ্রন্থটির নাম চর্যাপদ। চর্যার টীকাকার মুনিদত্তের টীকা  বা ভাষ্যরচনা থেকে পাওয়া গ্রন্থটির  শিরোনাম যথাক্রমে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' ও 'চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'।

১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য) চর্যাপদের পুঁথির সন্ধান পান।

নেপাল রাজদরবারে প্রাপ্ত সংকলিত গ্রন্থটির নাম ছিল 'চর্যাগীতিকোষ'। গ্রন্থের আবিষ্কর্তা শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর নতুন নামকরণ করেন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়।' 'চর্যাগীতি কোষ' গ্রন্থটি মূলতঃ টীকা বা ভাষ্য রচনা কেন্দ্রিক ব্যাখ্যামূলক একখানি পুঁথি ।  কিন্তু পুঁথিটির শেষের কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল বলে খণ্ডিত সেই পুঁথির টীকাকারের নাম জানা যায়নি।

■ চর্যার রচনা কাল:- 

চর্যার রচনাকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। গ্রন্থটির আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গ্রন্থের ব্যাখাকর্তা  ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতগণ চর্যাগীতি গুলিকে সাধারণ ভাবে দশম ও দ্বাদশ শতকের অন্তবর্তীকালের রচনা বলে মনে করেন। 

চর্যার পদকর্তা ও পদসংখ্যা :- 

চর্যাগীতিতে লুইপাদ, সরহপাদ, কাহ্নপাদ প্রভৃতি নামোপাধিযুক্ত ২৪ জন পদকর্তার ৫১ টি পদ সংকলিত হয়েছিল। তার মধ্যে সাড়ে ছেচল্লিশটিপদ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। চর্যাগীতিতে সংকলিত পদগুলির মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্নপাদ (পদসংখ্যা-১০টি) তারপরে ভুসুকুপাদ (পদসংখ্যা-৮) এবং সরহ বা সরহপাদ (পদ সংখ্যা-৪), বাকিপদ-কর্তাগণের কেউ তিনটি কেউ দুটি এবং কেউ একটি করে পদ রচনা করেন।

■ চর্যাপদের ভাষা :- 

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাচার্য-বিনিশ্চয় গ্রন্থের ভূমিকায় মুনিদত্তের সংস্কৃত ধারাভাষ্যের উপর ভিত্তি করে চর্যাপদের শ্লোকের রহস্যময় ভাষাকে সান্ধ্যভাষা বা আলো-আঁধারি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী বেশ কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে প্রমাণের ভিত্তিতে পরে এই ভাষাকে 'ইচ্ছাকৃত ভাষা' (সংস্কৃত: সন্ধ্যা-ভাষা) হিসেবে উল্লেখ করেন। চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা।

■ ছন্দ ও অলংকার:- 

চর্যার পদগুলি প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী পদে রচিত। এতে মাত্রাছন্দের প্রভাবও দেখা যায়। ১৬ মাত্রার পাদাকুলক ছন্দের ব্যবহারই এখানে বেশি। তবে সর্বত্র নির্দিষ্ট মাত্রারীতি দেখা যায়নি।

■ চর্যার সমাজচিত্র:- 

চর্যাগীতিগুলির বেশির ভাগই রচিত হয়েছে বাংলা দেশ ও বাঙালি-জীবনের পটভূমিকায়। ফলে প্রাচীন বাংলা ও বাঙালিজীবনের নানা ঘটনাবলী উঠে এসেছে চর্যার গানে।

অবশ্য সেখানে বাস্তব জীবনের ছবিগুলি অধ্যাত্মসংগীতে এক একটা আবরণ বা রূপকের ছদ্মবেশ নিয়ে ধরা পড়েছে। ফলে দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা যেমন জীবনচর্যা, তাদের আচার-ব্যবহার রীতি-নীতি, হাস্য-পরিহাস, বৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনৈতিক-অবস্থান, দাম্পত্য জীবনের প্রেম-প্রীতি-অনুরাগ-বিরাগ, সংশয়, বিশ্বাস, আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি খুটিনাটির বর্ণনা  প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের ঐতিহাসিক দলিল রূপে 'চর্যাগীতি'গুলিকে গ্রহণ করা যায়।

■  চর্যার সাহিত্যমূল্য:- 

চর্যাপদে বাস্তব অথচ কাব্যময় নিখুঁত দৃশ্য ছায়াছবির মতো পাঠকের মনের চোখের উপর দিয়ে ভেসে যায়। প্রকৃতি ও মানুষকে কত নিবিড় ভাবে চিনতে এবং ভালোবাসলে এই ছবিগুলি আঁকা যায় তা সহজেই অনুমেয়। 

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন ,  "প্রতীক রূপকের সাহায্যে চিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানব চরিত্রের মধ্যে সুখ-দুঃখের বিরহ মিলনের দৈনন্দিন জীবন চিত্র চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীব করিয়াছে"।

● প্রকৃতি বর্ণনা: চর্যাপদের পদগুলির মধ্যে গভীর গূঢ় অর্থ থাকলেও তার বাইরের সাধারণ অর্থে  প্রকৃতির নির্মল চিত্র ফুটে উঠেছে।

● আখ্যানধর্মীতা: আখ্যানধর্মীতা চর্যাপদের সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ। চর্যার কোনো কোনো পদে আখ্যান বা  কাহিনির সন্ধান মেলে।

● ছন্দ ও অলংকার প্রয়োগ:- চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রমাণ করা গেলেও কিন্তু কাব্য বিচারে এই সমস্ত মাপকাঠিই সব নয়। সবচেয়ে বড়ো মাপ কাঠি পাঠকের অনুভূতি। যদি সেই অনুভূতিতে কোনো কাব্য নাড়া দিতে পারে তবে তার ভাষা ছন্দ অলঙ্কার প্রয়োগের অসম্পূর্ণতা থাকলেও তা-ই সত্যিকার কাব্য। ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারের দিকে চর্যাপদ নিশ্চয় ত্রুটি মুক্ত নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও চর্যাপদকে সুষ্ঠু সুন্দর কাব্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না, কারণ চর্যাপদে আছে সুগভীর মানবতাবোধের নির্মল অনুভূতি। চর্যাপদ সেই দিক দিয়ে অমূল্য সৃষ্টি।

■ উপসংহার:-

 উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করে বলা যায় যে বৌদ্ধ সাধন সংগীত হলেও চর্যাপদ আদর্শ সাহিত্য হয়ে উঠেছে। চর্যার ভাব ও রূপ সাহিত্য গুণের দিক থেকে উৎকৃষ্ট ছিল বলেই পরবর্তী সাহিত্যে তাঁর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল। 

2. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কার কাল ও আবিষ্কারক কে ছিলেন ? এর  সমাজ চিত্র আলোচনা করো ?  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রকৃতি আলোচনা করো ?  2+3+5 ***

Ans:- আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এই একটি মাত্র গ্রন্থ আবিষ্কার ও প্রকাশের পর নিস্তরঙ্গ বাংলা সাহিত্যে তুমুল  আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল । দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধারণার মূলে আঘাত করেছিল এ কাব্যের আবিষ্কার।  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে চিন্তা-চেতনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য আবিষ্কারের ফলে।

■ আবিষ্কার কাল ও আবিষ্কারক:- 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুথিটি বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভ আবিষ্কার করেন ১৩১৬ বঙ্গাব্দে। তিনি বিষ্ণুপুরের কাছে কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মাচা থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিটি খুঁজে পান। পুঁথিটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'র আবিষ্কার কাল ১৩১৬ বঙ্গাব্দ। প্রকাশকাল  এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

■ সমাজ চিত্র:- 

■ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রকৃতি:- 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক কাব্য।  গ্রন্থটি ১৩টি অংশে বিভক্ত- জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালিয়দমন খণ্ড, হারখণ্ড, যমুনাখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ।

জন্মখণ্ডে কৃষ্ণ-আবির্ভাবের পৌরাণিক ভূমিকা রচনা করা হয়েছে। কংসের পাপে পীড়িতা পৃথিবীর দুঃখমোচনের জন্য ভগবান নারায়ণ কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দানখণ্ডে কৃষ্ণ মথুরার পথে দানী সেজে বসল এবং পথের বকেয়া মাশুলের পরিবর্তে 'দানী' কৃষ্ণ রাধার যৌবন দাবী করল দান হিসেবে। বিরহখণ্ডে রাধার হৃদয়ের আর্তির মধ্যে অসম্পূর্ণ গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে।


নাটগীতিমূলক এই আখ্যায়িকাতে লৌকিক জীবনের সমাজচিত্র বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। গ্রন্থমধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, কুমার, তেলী, নাপিত, বৈদ্য, আচার্য,  প্রভৃতি নানা জাতি-সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। ব্যবহারিক জীবনচর্যার দৈনন্দিন দিক থেকেও কবি বিভিন্ন উপাদন সংগ্রহ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে' সোনা, হীরা, মণি, মুক্তা ইত্যাদি রত্নের উল্লেখ-প্রাচুর্য সাধারণ লোকেরও সচ্ছল অবস্থার পরিচয় বহন করে । কবি গোয়ালিনী রাধাকেও নানা অলঙ্কারে সুসজ্জিতা করে তুলেছেন। এছাড়া সমকালীন লোকাচার ও লোকবিশ্বাস-এর পরিচয়ও পাওয়া যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে।

3. বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ভাগবত অনুবাদকের নাম কি? তাঁর অনুবাদকর্ম ও কবিত্ব প্রতিভার পরিচয় দাও। **  1+4

অথবা, 

মালাধর বসুর কবিপ্রতিভা আলোচনা করো । 5

অথবা, 

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের সম্পর্কে আলোচনা করো। 5

উ:- বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ভাগবত অনুবাদক হলেন মালাধর বসু।

পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি (প্রাক-চৈতন্যযুগের কবি) মালাধর বসু তার জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কুলিন গ্রামে। পিতা—ভগীরথ বসু, মাতা—ইন্দুমতী। কাব্যের শুরুতে কবি আত্মপরিচয় দিয়ে লেখেন-

"বাপ ভগিরথ মোর মা ইন্দুমতি।

জার পুজো হেল মোর তারা অনে মতি।"

‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়  ভাগবত পুরাণের অনুবাদক হলেন মালাধর বসু। ভাগবতে দশম ও একাদশ স্কন্ধের অনুবাদে  শ্রীকৃষ্ণের  জীবনমাহাত্ম বর্ণিত হয়েছে যেখানে বারোটি  স্কন্ধে বিভক্ত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব কৃদাসকবিরাজ বিরচিত শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে মালাধর বসুর শ্ৰীকৃবিজয় কাব্যের বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন।  

■ শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য :- 

শ্ৰীকৃবিজয়' কাব্যের রচনাকাল পঞ্চদশ শতাব্দী। কবির কথায় ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্য শুরু করেন এবং ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ করেন।এতে কাব্যটির রচনাকাল বিষয়ক একটি শ্লোক আছে, তা হল-

" তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরগুল।

চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন।।"

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যটি 'শ্রীকৃষ্ণবিক্রম', ‘গোবিন্দ বিজয়’ ও ‘গোবিন্দ মঙ্গল' নামেও পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণবিজয় তিনটি পর্বে বিভক্ত। আদ্য কাহিনি, মধ্য কাহিনি, অন্তু কাহিনি। মালাধর বসু ভাগবতের কাহিনির বাঙালি রুচিসম্মত সুক্ষ্ম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় শক্তিবৃদ্ধি ও বাঙালির রসানুভূতিকে দৃঢ় করে গেছেন। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণুবিজয়' কাব্যটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। চৈত্যচরিতামৃতম-এ উল্লেখ আছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাবাটির প্রশংসা করে বলেছেন-

" গুণরাজ খান কৈল 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়'।

তাঁহা এক বাক্য তাঁর আছে প্রেময়।।

জন্দের অন্দর কৃষ্ণ চোর প্রাণনাখ।

এই বাক্যে বিকাইন্তু তাঁর বংশের হাত।" 

শ্রীকৃষ্ণবিজয়' কাব্যে বাংলাদেশ ও বাঙালি জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় - বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বারকার চিত্র অঙ্কনের মধ্যে বাঙালি মনোভাব ও বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, বিভিন্ন ফলমূল, ছায়া সুশীতল এবং সৌরভপূর্ণ লাবণ্যময়ী বাংলাদেশের  কথাই রসঘন হয়ে উঠেছে। কবিত্ব শক্তির অভাব থাকা সত্ত্বেও 'শ্ৰীকৃবিজয় কাব্যটি বৈষ্ণব সমাজে সমাদৃত হয়েছিল কারণ—(ক) শ্রীকৃষ্ণবিজয় ভাগবতের অনুবাদ।

‘মধ্যযুগে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ বাংলা সাহিত্যকে পূর্ণতর মর্যাদা দিয়েছে।একথা বলার কারণ - প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার,বৌদ্ধযুগের অবসানে যে পৌরাণিক আদর্শ হিন্দুসমাজ ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল, তার প্রভাবে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সমাজ বিশেষভাবে নতুন রূপ লাভ করেছে। অনুবাদ সাহিত্যে তার স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। বস্তুত, এই অনুবাদগুলি না পাওয়া গেলে বাংলা সাহিত্য কোনোদিন ক্লাসিক মহিমা লাভ করতে পারত না।

4.  অনুবাদক হিসাবে কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো। * 5

উ:- বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের জগতে কৃত্তিবাস ওঝা স্মরনীয়। তিনি মূলত বাল্মিকির রামায়নের শ্রেষ্ট বাংলা অনুবাদক। তার রচিত রামায়ণের নাম হল শ্রী রামপাচালী।

■  প্রাথমিক জীবন:

কৃত্তিবাস ওঝা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩১ সালে অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে । তার পিতা ছিলেন বনমালী ওঝা। এবং পিতামহ মুরারি ওঝা ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত।

■ কৃত্তিবাসী রামায়ণ:- 

কৃত্তিবাসী রামায়ণ মূলত বাল্মিকী রামায়ণের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও, কৃত্তিবাস এই মহাকাব্য বাংলা নিজস্ব ভাবধারা ও স্থানীয় সংস্কৃতি সংযোজন করেছেন। তার লেখনীতে বাংলার গ্রামের ছবি, বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং তাদের আচার-আচরণের প্রতিফলন ঘটেছে। তাইতো আর রামায়ণ কাব্য বাংলা ভাষা মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে।

■ কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভাষা ও শৈলী:-

কৃত্তিবাসী রামায়ণের ভাষা ছিল সহজ, প্রাঞ্জল অসাধারণ মানুষের বোধগমা। তিনি সংস্কৃতের জটিলতা থেকে দূরে থেকে সরল বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন। তার অনুবাদ কাজ বাংলা ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলার গ্রামাঞ্চলের কৃত্তিবাসী রামায়ণের আসর বসতে শুরু করে। যেখানে মানুষ এই মহাকাব্য পাঠ করে শোনাতেন।

■ কৃত্তিবাসের মৌলিকতা:-

কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার হৃদয়ের ভাষা ও প্রাণের আকুতি। সংস্কৃত রামায়ণের কাহিনী, প্রেক্ষাপট ও চরিত্রগুলি অবিকৃত রেখে কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালির জীবনধর্মকে মন্ডিত করে ফেলেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ছায়াপাত ঘটেছে। রাম লক্ষণের ভাতৃত্ব,  সীতার দুঃখময় বধূজীবন, হনুমানের দাস্যভক্তি, সুগ্রীব বিভীষনের দাস্যভক্তি,  বাঙালির ঘরের জিনিস হয়ে উঠেছে। 

■ কৃত্তিবাসী রামায়ণ এর বৈশিষ্ট্য:-

বাঙালি ও বাংলার কবি কৃত্তিবাস বাল্মিকৃত সংস্কৃত রামায়ণের কাঠামোর মধ্যে নিজের কবি কল্পনাকে মূর্ত করে বাঙালির মন দিয়ে বাঙালির মতো রামায়ণ রচনা করেছেন। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য বাঙালির বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ।  কৃত্তিবাসী রামায়ণের কৃত্তিবাসী স্বরূপে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের পরিচিত জীবন থেকে লৌকিক উপমা রূপক কাজী ব্যবহার করে কৃত্তিবাসী বক্তব্যকে খুবই তির্যক ও তীক্ষ করে তুলেছেন। অলংকার প্রয়োগে কবির কৃতিত্ব এই যে সংস্কৃত অলংকারের সঙ্গে দৈনন্দিন বাঙালির জীবন স্থান পেয়েছে। ফলে কৃত্তিবাসী সৃজনশীল প্রতিভা ফুটে হয়ে উঠেছে।

5.  মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কাশীরাম দাসের অনুবাদকর্মের পরিচয় দাও। * 5

উ:-■  কাশীরাম দাসের ভারত পাঁচালী:-

মধুসূদন দত্ত কাশীরাম দাস সম্পর্কে বলেছিলেন- "হে কাশী কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।"  কথিত আছে কাশীরাম মেদিনীপুরের  জমিদারের আশ্রয়ে থেকে পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন। সেসময় রাজবাড়িতে যে সমস্ত কথক এবং পুরাণ পাঠকারি পণ্ডিত আসতেন, তাদের মুখ থেকে মহাভারত প্রসঙ্গ শুনে তাঁর মহাভারতের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। এই অনুরাগের ফলেই তিনি মহাভারতের অনুবাদ শুরু করেন। কাশীরামের লেখা মহাভারতের অনুবাদ গ্রন্থটির নাম 'ভারত পাঁচালী'। এটি সম্ভবত তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রচনা করেন

কাশীরাম দাস মহাভারতের অনুবাদ করলেও তিনি মহাভারতের প্রথম অনুবাদক নন। তুর্কি আক্রমণোত্তর কালে উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন সংস্কৃতে লেখা পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থগুলির অনুবাদ শুরু হয়, মহাভারতের অনুবাদও তখনই শুরু হয়। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক হিসাবে কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে ধরা হয়। তবে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসাবে কাশীরাম দাসই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। 

■ কাশীরাম দাসের কবি প্রতিভা:- 

কাশীরাম দামের কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই বলেন যে, তিনি মহাভারতের সম্পূর্ণ অনুবাদ করতে পারেননি। আদি, সভা, বন ও বিরাট-এই চারটি পর্ব অনুবাদ করেন। বাকি অংশটুকু তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র নন্দরাম সমাপ্ত করেন। সমালোচকদের এই অনুমানের পিছনে একটি কারণ হল কাশীরাম দাম তার অনুবাদে নিজেই লিখেছেন- " আদি, সভা, বল, বিরাটের কতদুর।

ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।" 

যাইহোক কাশীরাম দাস মহাভারতের সম্পূর্ণ অণুবাদ করুন আর না করুন শুধুমাত্র এই চারটি পর্বের অনুবাদ বিচার করলেও তার কবি কৃতিত্ব ছোট করা যায় না। কাশীরাম দাস সংস্কৃত মহাভারতের হুবহ অনুবাদ করেননি, তিনি মহাভারতের ভাবানুবাদ করেছেন। 

কাশীরামের অনুবাদটি পড়লে কখনোই মনে হয় না যে, তিনি সংস্কৃত জানতেন না। হয়তো শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য। তিনি কিছু কিছু জায়গায় মহাভারতের সংস্কৃত শ্লোক যেভাবে বাংলায় রূপান্তরিত করেছেন তা লক্ষ করলে তাঁকে সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত বললেও কম বলা হয়। 

 কাশীরাম দাস চৈতন্যোত্তর যুগের কবি ছিলেন এবং নিজেও বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর রচনার ভাব ও ভাষায় চৈতন্যদেবের একটা প্রভাব পড়েছিল। তিনি তাঁর রচনায় মূল মহাভারতের রুক্ষ্মতা, শুষ্কতা, বৈরিতা অনেকটাই কমিয়ে এলেছিলেন। 

কাশিরামের অনুবাদ গ্রন্থে বাঙালিয়ানার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, লড়াই-সংঘাত। তবুও কাশীরাম যে তাঁর রচনাটি বাঙালির উপযোগী করে লিখেছিলেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর হয়ত এই কারণেই আজও মহাভারতের কথা মনে পড়লে সবার আগে স্মরণে আমে কাশীরাম দামের সেই বিখ্যাত শ্লোক-

" মহাভারতের কথা অমৃত সমান।

কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।" 

দীনেশচন্দ্র সেন মহাভারতের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- "এক একখানি পত্র এক একটি চমৎকার চিত্রপটের ন্যায়, পড়িতে পড়িতে জগৎপুঞ্জ, যুদ্ধবীর ও প্রেমিকগণের মূর্তি মানসভক্ষের সমক্ষে উদঘাটিত হয়। 

6. বৈষ্ণব পদাবলী বলতে কী বোঝ? এর বিষয়বস্তু কী? **

উ:- ■ বৈষ্ণব পদাবলী :- 

বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা-সাহিত্যের এক মহামূল্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য একটি বিস্তৃত কালপর্ব জুড়ে বিন্যস্ত। 'বৈষ্ণব' অর্থাৎ বিষ্ণু যাদের উপাস্য দেবতা, আর 'পদাবলী' হল পদ সমষ্টি বা গানের সমষ্টি। প্রাক-চৈতন্যযুগে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য ও চৈতন্য পরবর্তী যুগে গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস বিশেষভাবে খ্যাতিমান হলেও আরও বহু কবি বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত পদ লিখেছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল বিষয়বস্তু হল কৃষ্ণের লীলা এবং মূলত মাধুর্যলীলা। রাধাকৃষ্ণলীলাকথাই প্রধানত পদাবলীর মূল বিষয়বস্তু। রাধা-কৃষ্ণ প্রাসঙ্গিক কথাকে নানা পর্যায়ে বিভক্ত করে পদকর্তারা বিভিন্ন পদ রচনা করেছেন এবং তাঁদের বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। 

■ বিষয়বস্তু:- 

(a) কৃষ্ণ তত্ব:- 

বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান পুরুষ বা পরমপুরুষ হলেন কৃষ্ণ। তিনি আবার সমস্ত বৈষ্ণবের কাছে প্রধান আরাধ্য দেবতাও অর্থাৎ পরমব্রহ্ম ভগবান। উপনিষদের ব্রহ্ম ও পুরাণের বিষ্ণুর মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। তাঁদের কাছে শঙ্খ-চক্র-গদাধারী শ্রীবিষ্ণু আরাধ্য মূর্তি নয়; বরং আরাধ্য দেবতা হলেন বংশীধারী নন্দদুলাল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের ৪র্থ পরিচ্ছেদে বলেছেন,

'পূর্ণ ভগবান অবতারে যেই কালে।

আর সব অবতার তাঁতে আসি মিলে।'

(b) শ্রীরাধাতত্ত্ব:- 

বৈষ্ণবধর্মে ও সাহিত্যে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের মতো রাধা ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। বৈষ্ণব দর্শনে শ্রীকৃষ্ণ নানান লীলাশক্তির অধিকারী। কৃষ্ণের এই শক্তিকে কোথাও কোথাও তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে-স্বরূপ শক্তি, তটস্থা বা জীবশক্তি ও মায়াশক্তি। রাধার এই রূপ ও তত্ত্বের প্রকাশ বিকশিত হয়ে ওঠে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের পরে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাধার ভাব ও কান্তি নিজ অঙ্গে ধারণ করেই। কৃষ্ণদাস বলেছেন,

"কৃষ্ণ বলে নাচে কাঁদে হাসে অনুক্ষণ।

 যারে দেখে তারে কহে কহ কৃষ্ণনাম।'

(c) গোপীতত্ত্ব:-

হরিবংশের পরে রচিত ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণে গোপীগণের উল্লেখ আছে। সেখানে রাধার কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ না থাকলেও প্রধান এক সখীর সঙ্গে কৃষ্ণের রাসলীলার কথা উল্লিখিত আছে। হরিবংশেও গোপীদের কথা আছে যে, তারা সংসার বন্ধন তুচ্ছ করে জীবনকে মধুর করে উপভোগ করবার জন্যে কান্তার সঙ্গে মিলিত হোত। তারাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার সহায়িকা। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার লীলা দর্শনই তাদের একমাত্র কাম্য বস্তু। আবার এই গোপী বা সখীহীনা রাধা অসম্পূর্ণা। 5. বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর অবস্থান নির্ণয় করো।

7.  বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণ নির্দেশ করো। **

উ:- ■ বিদ্যাপতি:- 

বিদ্যাপতি বাঙালী ছিলেন না, বাংলা ভাষায় তাঁর কোন রচনা নেই, তবু, মিথিলার এই প্রতিভাময় কবি বাংলা সাহিত্যে যেমন অনায়াসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন তেমনি ভারতীয় সাহিত্যে 'কবি সার্বভৌম' রূপে অভিহিত হয়েছেন। তিনি শৈব ধর্মে দীক্ষিত হয়েও বৈষ্ণব কবিতা রচনায় যেমন অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি পাশাপাশি রচনা করেছেন প্রাকৃত-অবহট্ঠ ও সংস্কৃত ভাষায় জীবনীকাব্য এবং পুরাণ গ্রন্থাদি। বিদ্যাপতি-রচিত বিভিন্ন গ্রন্থগুলি হলো কীর্তিলতা ,  ভূপরিক্রমা, পুরুষ পরিক্রমা , কীর্তিপতাকা ইত্যাদি।

■ বিদ্যাপতির বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কারণ :- 

বিদ্যাপতি বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ না করলেও, বাংলায় পদরচনা না করলেও বাঙালীর হৃদয়ে সমাসীন হয়েছেন কবি। তাঁর পদাবলী বাঙালীর হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদাবলী আস্বাদন করে পরম আনন্দ লাভ করতেন

'চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি

কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।

স্বরূপ রামানন্দ সনে

মহাপ্রভু রাত্রিদিনে

গায় শুনে পরম আনন্দ।'

বিদ্যাপতির পদে প্রেমের, মধুর রসের বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে। বৈষ্ণবীয় 'কান্তাপ্রেম'-এর সমৃদ্ধ কাব্যরূপ বিদ্যাপতিকে অমরত্ব দিয়েছে। মিথিলা বিদ্যাপতির জন্মস্থান হলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তরা তাঁর পদে তাঁদের সাধনার বিষয় খুঁজে পেয়েছিলেন বিশেষ ভাবেই।

বিদ্যাপতি বাংলায় পদ রচনা না করলেও বাঞ্জলীর হৃদয়ে সমাসীন হয়েছেন। তাঁর পদাবলী বাঙালীর হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদাবলী আস্বাদন করে পরম আনন্দ লাভকরতেন। বাংলা ও মিথিলা এই দুই স্থানের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক সুসম্পক স্থাপিত হওয়ার কারণে মৈথিল ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার, আসামের ছাত্রদের ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার সংযুক্তি ঘটে। 'মৈথিল' ভাষায় বৈষ্ণব কবিতা রচনা করে বাঙালী তথা বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতি অর্ন্তভুক্ত হয়ে গেছেন।


8.  'পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস' - আলোচনা করো। **

উ:- প্রাক-চৈতন্যযুগেই নয়- মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যে চণ্ডীদাস একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত। সহজ-সরল ভাষায়, প্রেমের আনন্দ মধুর বেদনাকে, রস সমৃদ্ধ করেছেন কবি চণ্ডীদাস। জনশ্রুতি অনুসারে বীরভূম জেলার নায়ুর গ্রামে চণ্ডীদাস বাস করতেন।চন্ডীদাস 'পূর্বরাগ ও আক্ষেপানুরাগ'-এর শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর প্রতিভার প্রকাশ এই সব পর্যায়ের পদেই।

চণ্ডীদাসের পদাবলীর মধ্যে পূর্বরাগ পর্যায়ের পদগুলি যেমন আক্ষেপানুরাগের প্রকাশ ঘটে। নিজের বিরূপ ভাগ্য তার এই দুঃখের কারণ তাই, আপাত ভাবে যেসব বিষয়াদি জীবন নির্বাহের পক্ষে অনুকূল সেই গুলিই রাধিকার কাছে বিরূপ হয়ে প্রতিভাত হয়েছে-

অবিস্মরণীয় করে রাধার চন্ডীদাস রাধিকাকে বিরহিনী রূপেই প্রভাসিত করেছেন।  রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- 'বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি।'

"যমুনার জলে যাঞা যদি দিই ঝাঁপ।

পরাণ জুড়াবে কি অধিক উঠে তাপ।।

 অতএব এ ছার পরাণ যাবে কিসে।

নিচয়ে ভখিমু মুঞি এ গরল বিষে।।"

■ চণ্ডীদাসের পদাবলীর বৈশিষ্ট্য:- 

চন্ডীদাস প্রেমের কবি, তাঁর কবিতা প্রেমের কবিতা। যে প্রেমে আত্মানুভূতি প্রবল, আত্মনিবেদন মুখ্য সেই প্রেমের ব্যাকুলতা ও আবেগ আরো গভীর মর্মস্পর্শী ভাবে তিনি চিত্রিত করেছেন। 

চণ্ডীদাসের সরল সহজ ভাষা সত্যিই শ্রোতার মন হরণ করে নেয়। চণ্ডীদাস যে ভাবের কবি তা তাঁর পদাবলী পড়তে পড়তেই বোঝা যায়। 

তিলে তিলে আইসে যায়।

ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার

মন উচাটন  নিশ্বাস সঘন

কদম্ব কাননে চায়।

সবশেষে চণ্ডীদাসের কবিতার ভাষার কথা। এ ব্যাপারে রবীন্দ্র-উক্তিই যথেষ্ট "আমাদের চণ্ডীদাস সহজ ভাষার সহজ কবি, এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি। তিনি একছত্র লেখেন ও দশছত্র পাঠককে দিয়া লেখাইয়া লন।"

9.  রোম্যান্টিক কবি জ্ঞানদাসের পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করো। **

উ:-  চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি-জ্ঞানদাস। তিনি দীক্ষিত বৈষ্ণব কবি; নিত্যানন্দ জাহ্নবাদেবী তাঁর দীক্ষাগুরু। তিনি ভক্ত কিন্তু রোমান্টিক মনের অধিকারী।কাটোয়ার কাছে কাঁদড়া গ্রামে আনুমানিক ১৫৩০ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করেন। চন্ডীদাসের মতো জ্ঞানদাসও ছিলেন রোমান্টিক কবি। তিনি ষোল শতকের পদাবলী সাহিত্যের একজন সেরা কবি। তার সুনাম চন্ডীদাস বা বিদ্যাপতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। 

■ জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা:- 

রোম্যান্টিক কবি জ্ঞানদাস এর কবিতায়  কৃষ্ণ রূপের বন্দনা এত অপূর্বভাবে ফুটে উঠেছে-

" রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর।

 প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।। "

জ্ঞানদাস একজন উৎকৃষ্ট পদাকার ছিলেন। তার কিছু স্মরনীয় পদ আছে। যেমন, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর, কিংবা সুখের লাগিয়ে এ ঘর বান্ধিলুঁ ইত্যাদি। এই সব পদ বৈষ্ণব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। পদাবলীর গুণ ও মান বৃদ্ধিতে জ্ঞানদাসের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ষোল শতক পদাবলীর স্বর্ণযুগ। জ্ঞানদাস এই স্বর্ণযুগের কবি। ভক্তের অনুভূতিকে কবিতায় প্রকাশ করার অপূর্ব প্রতিভা তার মধ্যে ছিল।

শব্দব্যবহার ও ভাষাভঙ্গি একই রকম বলে জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের অনুসারী বলা হয়। অকৃত্রিম সহজ রচনারীতির দিক থেকে চন্ডীদাসের সঙ্গে তার মিল অবশ্যই আছে। কিন্তু জ্ঞানদাস একজন সতন্ত্র কবি। আধুনিক কালের গীতিকবিতার বৈশিষ্ট তার পদে পাওয়া যাবে।

জ্ঞানদাসের নামে প্রায় শ'দুয়েক পদ চালু আছে। ব্রজবুলিতেও তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন। তবে তার বাংলা পদগুলো ব্রজবুলির পদের তুলনায় অনেক ভাল। তবে রুুপানুরাগের পর্যায়ের পদ গুলোই জ্ঞানদাসের কলমে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। দুটো রুুপানুরাগের পর্যায়ের পদ হল--

“রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।

ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরান

জ্ঞানদাস সঙ্গীত বিষয়েও একজন বিশেষজ্ঞ। একালে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যেমন নিজেদের লেখার গানে সুর দিয়েছেন, সেকালে জ্ঞানদাসও একই কাজ করেছেন। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে জ্ঞানদাস বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি গান লিখে সুর দিয়েছেন। 

10.  'গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।' কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ** অথবা, গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলা হয় কেন ? 

উ:-  গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য ছিলেন– কথাটি বহুল প্রচলিত । একে তো তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে পরিচিত ছিলেন, তার ওপর আবার বিদ্যাপতির সঙ্গে ভণিতায়ও তার নাম বহুবার উচ্চারিত হয়েছে । বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের কাব্যের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।  

তিনি যে সজ্ঞানে বিদ্যাপতির অনুসরণ করেছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এই কারণেই উভয়ের রচনায় ভাবগত ঐক্যও বর্তমান। “এঁদের কাব্যে ভাব এবং রীতির মধ্যে ব্যবধান তেমন দেখা যায় না । উভয় কবিই বস্তুতে বিভোর হয়েছেন ফলে এঁদের কাব্যের সর্বত্রই ভাবের সাথে রূপের, শিল্পের সাথে শিল্পীর, মনের সাথে মননের একটি ব্যবধান রয়ে গেছে। বিদ্যাপতির মতোই তিনিও কাব্যের বহিরঙ্গের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

অবিমিশ্র ব্রজবুলি ভাষা, ছন্দের বৈচিত্র্য, অলঙ্কারের বহুল ব্যবহার ইত্যাদিতে বিদ্যাপতির অনুসরণপ্রিয়তাই লক্ষ্য করা যায়। এমনকি তিনিও বিদ্যাপতির মতোই কৃষ্ণলীলাকাহিনীর দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন। 

 বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস উভয়েই সচেতন শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও কাব্যকলাপ্রয়োগের কতকগুলি বিশেষ দিকে গোবিন্দদাস উৎকৃষ্টতর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছন্দোবৈচিত্র্য, অলঙ্করণ ইত্যাদি। 

ভাবোল্লাস ও প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতি সমধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু অভিসারের পদে গোবিন্দদাস তাঁকে অতিক্রম করে গেছেন। গৌরচন্দ্রিকার পদ-রচনায় গোবিন্দদাস ভাবোচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে কাব্যের বহিরঙ্গ-গঠনে সংযত কবি-কল্পনার পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্যাপতির অবশ্য গৌরচন্দ্রিকা রচনার কোনো সুযোগই ছিল না।

গোবিন্দদাসের কাব্যে যে একটা অপূর্ব গীতি-মূর্ছনা লক্ষ করা যায়, তেমনটা বিদ্যাপতির ছন্দ-সুষমাযুক্ত পদেও পাওয়া যায় না। গোবিন্দদাসের কাব্যে যে সুরের সম্পূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়, বিদ্যাপতির কাব্যে ছন্দ-ধ্বনি-অলঙ্কার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সুরের মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাক থেকে যায়। বাক্যজালের জটিলতায় জড়িয়ে বিদ্যাপতির কাব্য যেখানে নীরস বলে প্রতিভাত হয়, গোবিন্দদাসের নিটোল কাব্য সেখানে রসে টই-টুম্বর। “বিদ্যাপতির নিকট গোবিন্দদাসের ঋণ ছন্দের জন্য, সুরের জন্য নয়। 

মিলনের পদ-রচনায় বিদ্যাপতির দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন রূপের, জীবনভোগের কবি, তাই তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায় যৌবনের উচ্ছ্বাস ও প্রেমের নৃত্য। মিলনের মতোই বিরহের পদ রচনাতেও বিদ্যাপতি ছিলেন অধিকতর সার্থক। ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’ কিংবা ‘শুন ভেল নগরী। শুন ভেল দশ দিশ, শুন ভেল সগরি। প্রভৃতি পদের কাব্যসৌন্দর্য ভাবগভীরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদ্যাপতিকে অসাধারণ কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এইক্ষেত্রে গোবিন্দদাস অনেকটাই ব্যর্থ। ভাষার ঐশ্বর্য আর ছন্দ ঝঙ্কারের মধ্য দিয়ে শ্রীমতীর আর্তি যথাযথভাবে ফুটে উঠবার অবকাশ পায়নি।


11. যুগবিভাগ বলতে কী বোঝানো হয়ে থাকে? যুগবিভাগের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। 2+3

উ:- ■ বাংলা সাহিত্যে যুগ বিভাজন :- 

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছর বা তার কিছু অধিক সময়ের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের এই হাজার বছরের অধিক কালের ইতিহাস কে মনে রাখার সুবিধার্থে বা কালের প্রবাহ কে স্বীকার করে নিয়ে কয়েকটি যুগ বা প্রর্যায়ে ভাগ করে নিতে পারি। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সাল তারিখের হিসেব স্পষ্ট যুগ বিভাগ করা যায় না। সাল তারিখ দেখে যুগের আরম্ভ হয় না, যুগের পরিসমাপ্তিও ঘটেনা। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে। 

■ যুগ বিভাজনের পর্যায় :- 

বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ নির্ধারিত হয়েছে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কে প্রধানতঃ তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে।

১। প্রাচীন যুগ বা আদিযুগ (৭৫০-১২০০) ,

২।মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০) ও 

৩।আধুনিক যুগ (১৮০১- বর্তমান সময় পর্যন্ত) ।

প্রাচীন যুগ :

   ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আদি মধ্য যুগের প্রাচীনতম ও একমাত্র গ্রন্থ হল "চর্যাপদ"।

মধ্য যুগ :

 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের বিস্তার ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মধ্য যুগকে আবার দুটি উপবিভাগে ভাগ করা হয় যথা- আদি মধ্যযুগ(১৩০১-১৫০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১ - ১৮০০)। আদি মধ্য যুগের সাহিত্যিক নিদর্শন গুলির মধ্য প্রথমের উল্লেখ করা যায় বড়ু চণ্ডীদাসের "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন"। এছাড়াও কৃত্তিবাসের "রামায়ণ", মালাধর বসুর "শ্রীকৃষ্ণবিজয়" বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গল কাব্য প্রভৃতি আদি মধ্যযুগের নিদর্শন। অন্ত মধ্যযুগের সাহিত্যিক নিদর্শন গুলি হল মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল, বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ, ভারতচন্দ্রের অন্নদা মঙ্গল ইত্যাদি।

আধুনিক যুগ:

  আধুনিক যুগ বলে বাংলা সাহিত্যে স্পষ্ট যুগবিভাগ নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। তা হলেও মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন।

 12. বাংলা ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করো। *** 5

উ:- খ্রিস্টীয় হাজার সালের পূর্বেকার বাংলা ভাষার কোন নিদর্শন না থাকায় বাংলা ভাষার উৎস খোঁজা কঠিন তবে এতটুকু জানা গেছে আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার অন্যতম হলো বাংলা ভাষা। সংস্কৃতির সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে কিন্তু তা প্রত্যক্ষ নয়। sanskrit হল ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের প্রাচীন ভাষা। বাংলা ভাষা উদ্ভবের সূত্র পৃথিবীর ভাষা বংশের নিহিত। ভাষার সাদৃশ্য বিচারে পৃথিবীর প্রায় 4000 ভাষাকে বারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানএর মধ্যে প্রধান ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ।

        ইউরোপ ও এশিয়ার বহু ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে এসেছে । ক্রমবিবর্তনের পথে বাংলা ভাষার জন্ম এই উন্নত বংশে। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দুটি গুচ্ছ :- ১. সত্যম ২. কেন্তুম। সত্যম গুচ্ছের একটি ভাষা ইন্দো-ইরানীয়। এই ইন্দো-ইরানীয় শাখা ভারতের সিন্ধু উপকূলে প্রবেশ করে প্রায় 2000 বছর আগে। ভারতে প্রবেশকারী শাখা ভারতীয় আর্য নামে পরিচিত হয়  । খ্রিস্টের জন্মের আগে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তৃতি ও বিবর্তন চলে। এই বিবর্তনের তিনটি ভাগ :-

১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য, ২. মধ্য ভারতীয় আর্য ৩. আধুনিক ভারতীয় আর্য।

১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য:-     এই ভাষার সময়কাল পনেরশো ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দদ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এই ভাষার প্রধান সাহিত্যিক কৃতি হল বেদ। ঋক বেদ এগুলির মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ।  বেদের ভাষা বৈদিক ভাষা নামে পরিচিত। এই বৈদিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে সংস্কৃত ভাষার দুটি রূপ সেই সময় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।  একটি  হল সাহিত্যিক অপরটি হল কথ্য।

২. মধ্য  ভারতীয় আর্য  :-   600 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 900 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে লৌকিক বা কথ্য সংস্কৃত রূপান্তরিত হয়েছিল প্রকৃত তথা মধ্য ভারতীয় আর্য। এই সময়কার ভাষা পালি ভাষা নামে পরিচিত । অশোকের অনুশাসনের শিলালিপি এই ভাষায় নিদর্শন আছে। একসময় বিবর্তনের পথে প্রাকৃত ভাষা অপভ্রংশ ও অবহট্টের পরিবর্তিত হয়। এই অপভ্রংশের তিনটি স্তর :- ১. শৌর শ্রেণী ২. মহারাষ্ট্রীয় ৩. মাগধি। অনেকে বলে থাকেন এই মাগধী অপভ্রংশ বাংলা ভাষার উদ্ভব এর উৎস। 

৩. আধুনিক ভারতীয় আর্য :- 900 খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই ভাষান্তরের ব্যাপ্তি। বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে মোটামুটি 10 শতকে হিন্দি ,বাংলা, গুজরাটি ,মারাঠি প্রভৃতি ভাষার জন্ম। এর সবই আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার নিদর্শন। এক সময় অপভ্রংশের ও অবহট্টের  বিবর্তন প্রাচীন বাংলা ভাষার সৃষ্টি করে। এই প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন চর্যাপদ।

15.  বঙ্গলিপির উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করো।* 5

উ:- ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম লিপির সন্ধান পাওয়া যায় অশোকের বিভিন্ন অনুশাসনে। অশোকের অনুশাসনে দু-প্রকার লিপি পাওয়া যায় – ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী। লিপি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আরামীয় লিপি থেকে ভারতের আদিলিপি ব্ৰাহ্মী ও খরোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। খরোষ্ঠী লেখা হত ডান থেকে বাম দিকে এবং ব্রাহ্মী লেখা হত বাম থেকে ডান দিকে। অবশ্য ডান থেকে বাম দিকে লেখার নিদর্শনও রয়েছে। ব্রাহ্মী থেকে আধুনিক নাগরী, বাংলা প্রভৃতি ভারতীয় লিপির জন্ম হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে ব্রাহ্মী লিপির দুটি আঞ্চলিক রূপ গড়ে ওঠে – উত্তর ভারতীয় রূপ এবং দক্ষিণ ও বহির্ভারতীয় রূপ। এর দ্বিতীয় রূপটি থেকে পল্লব লিপির উদ্ভব হয়, যার থেকে গ্রন্থি, মালয়ালম, তামিল, তেলুগু, কন্নড় ও সিংহলি লিপির জন্ম হয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় রূপই হল কুষাণ লিপি। চতুর্থ শতাব্দীতে অর্থাৎ গুপ্তরাজাদের শাসনকালে কুষাণ লিপি বিবর্তিত হয়ে গুপ্ত লিপি নাম ধারণ করে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত লিপি থেকে ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপির জন্ম হয়। সপ্তম শতাব্দীতে এই সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকেই কুটিল লিপি উদ্ভূত হয়।

এই কুটিল লিপি অষ্টম শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই পাঁচটি শাখার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারত শাখা বা শারদা লিপি থেকে তিব্বতি, কাশ্মীরি ও গুরুমুখি লিপি; উত্তর ও মধ্যভারত শাখা থেকে দেবনাগরী, কায়থী ও গুজরাটি লিপি; মধ্য এশিয়া শাখা থেকে খােটানি লিপি এবং যবদ্বীপ-বালিদ্বীপ শাখা থেকে যবদ্বীপীয় কুটিল লিপি উদ্ভূত হয়।

কুটিল লিপির পঞ্চম শাখা বা পূর্ব-ভারত শাখার লিপি হল প্রত্ন বাংলা লিপি বা গৌড়ীয় লিপি। নবম শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের রাজা নারায়ণ পালের তাম্রশাসনে এই লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এই প্রত্ন বাংলা লিপি থেকে নেপালি, ওড়িয়া, মৈথিলি, বঙ্গলিপি – এই চার প্রকার লিপি উদ্ভূত হয়েছে। এইভাবেই ব্রাহ্মী লিপি থেকে ক্রমে ক্রমে বঙ্গলিপি বা বাংলা লিপির উদ্ভব হয়েছে।

Saturday, December 28, 2024

B.A

 Note for B.A 

1. Chola Naval Expedition Click Here

2. History of NorthBengal Click Here

3. হো চি মিন ও কিউবা Click Here

4. ভূমি রাজস্ব ও নবজাগরন Click Here

5. নৌ বিদ্রোহ ও মর্লে মিন্টো Click Here

6. ট্রুম্যান ও ভারতছাড়ো Click Here

7. ঠান্ডা লড়াই Click Here

8. ভারত ভুক্তি click here

9. বাংলা Mejor 2 Click Here

10. সমীহ্মা Click Here

11.5Th Sem history Click Here

12.Core 12 Click Here

13. 5Th sem Click Here

14. চীন জাপানের ইতিহাস Click Here

Wednesday, July 24, 2024

বাংলা Mejor 2 CBPBU

CBPBU MEJOR 2 BENGALI

Marks:- 10

১) বাংলা গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের   (১৮২০-১৮৯১) অবদান আলোচনা করো । 

বাংলা গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের   (১৮২০-১৮৯১) অবদান :- 

বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় ভাষাশিল্পী ও শিক্ষাব্রতী হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রামমোহনের পথ বেয়ে উনিশ শতকে তার গদ্যচর্চার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়। বছর আটেক গ্রামের স্কুলে পড়াশোনার পর কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের মল্লিকের বসতবাটি সংলগ্ন এক প্রাণমারি স্কুলে ঈশ্বরচন্দ্র ভর্তি হন। ১৮২৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। এখানে অল্প দিনের মধ্যেই ঈশ্বরচন্দ্র মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। 



১৮৪১ সালে বিদ্যাসাগর উপাধি প্রাপ্ত ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করার পর বাংলা ভাষার অধ্যাপনার জন্য এই কলেজে যে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেখানে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলেজের প্রথম পণ্ডিতের স্থানে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইউরোপীয় কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শেখানো ছিল প্রধান পণ্ডিতের কাজ। 

 প্রথমেই প্রাচীন সংস্কৃত বইগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণের দায়িত্ব নেন। শুধু ব্রাহ্মণ, বৈদ্যই নন সকলের জন্য পড়ার ব্যবস্থা করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের রীতির ও পরিবর্তন করেন। পাশাপাশি সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেন।

বাংলা গদ্য সাহিত্য ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরে অবদান বড়ো কম নয়। বাংলা গদ্যকে একটা নিজস্ব রূপ দেওয়ার তিনি চেষ্ট করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা গদ্যের মাধুর্য ও গাম্ভীর্য। বিদ্যাসাগরের রচনা সমূহকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়-

১ অনুবাদ ও অনুবাদমূলক রচনা, 

২ শিক্ষামূলক রচনা,

 ৩ সংস্কারমূলক রচনা, 

৪ মৌলিক রচনা, 

৫ বেনামী রচনা। 

১ অনুবাদ ও অনুবাদমূলক রচনা:-

অনুবাদক যদি সৃজনশীল হন তাহলে তাঁর কর্মের ক্ষেত্রেও মৌলিকত্বের ছাপ পড়ে। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। তাঁর সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থগুলো ছিল হিন্দি, ইংরেজি ও সংস্কৃতের অনুবাদ। অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম কথা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করেছিলেন। অনুবাদ জাতীয় রচনার মধ্যে তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ 'বেতালপঞ্চবিংশতি'। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ সালে। এরপর লেখা হয় কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'-এর বাংলা অনুবাদ 'শকুন্তলা' (১৮৫৪)। এরপর ১৮৬০ সালে ভবভূতির 'উত্তররামচরিত' ও বাল্মীকির রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে লেখা হয় অনুবাদ মূলক রচনা 'সীতার বনবাস'। লঙ্কা বিজয়ের পর রামের পরবর্তী জীবন ও সীতার জীবনের যন্ত্রণাময় পরিসমাপ্তি নিয়েই এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের জীবিতকালেই বইটির পঁচিশবার সংস্করণ হয়। 

২ শিক্ষামূলক রচনা:-

শুধু অনুবাদ নয় যুগের প্রয়োজনে ও তাগিদে তাঁকে পাঠ্যপুস্তকও রচনা করতে হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে পাঠক সমাজে যাতে উচ্চাঙ্গের রস পরিবেশন করতে পারেন সেইকথা ভেবেই তিনি লেখেন 'বর্ণপরিচয়', 'কথামালা', 'বোধোদয়' ইত্যাদি। পদের মধ্যে দিয়ে সহজ সরল কথাভাষায় বিবৃতিতে তিনি যে উপস্থাপন কৌশল দেখিয়েছেন তা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার

 ৩ সংস্কারমূলক রচনা:-

এছাড়া উল্লেখ করতে হয় বিদ্যাসাগরের বিতর্কমূলক গ্রন্থগুলো; যা সেসময় সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই রচনাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' দুটি খণ্ড যা প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে। শাস্ত্রীয় বচন এর মধ্য দিয়েই বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সুকৌশলে আপন বিনয়কে বজায় রেখে নিজে মত প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের রচনার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট হল তিনি তর্ক বিতর্ক করেছেন নানারকম যুক্তির মধ্য দিয়ে। 

৪ মৌলিক রচনা:-

 বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'। এরপরে উল্লেখ বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'বিদ্যাসাগর চরিত' (১৮৯১)। গ্রন্থটির মাত্র দুটি পরিচ্ছেদ লেখার পরেই বিদ্যাসাগর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বইটি পুত্র নারায়ণচন্দ্র 'বিদ্যাসাগর চরিত' নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। 

৫ বেনামী রচনা।:-

এখানেই শেষ নয় বিদ্যাসাগর বেনামে পাঁচটি রচনা প্রকাশ করেছিলেন। কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য ছদ্মনামে তিনি রচনা করেছিলেন 'অতি অল্প হইল' (১৮৭৩) এবং 'আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩)। এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে বিদ্যাসাগর বেনামে তৎকালীন পণ্ডিত তারানাথ তর্ক বাচস্পতিকে বহুবিবাহ রহিত বিষয়ক জবাব দিয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী রচনাও ছদ্মনামে রচিত এর নাম 'ব্রজবিলাস' (১৮৮৫) ।

মূল্যায়ন:-

বিদ্যাসাগর শুধু বাংলা গদ্যের বাহক নন, ধারক হয়েও রয়ে গেছেন আমাদের মধ্যে। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী। বিদ্যাসাগর এর পূর্বে বাংলা গদ্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও বাংলা গদ্যকে তার জটিলতা, আড়ষ্টতা থেকে মুক্ত করে এক মৌল পথ দিয়েছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। এইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন 'বিদ্যাসাগরের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই।' 

2.বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো

মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য যেভাবে পুরানো রীতি - সংস্কৃতি ত্যাগ করে নতুন ধারায় পুষ্টি পেয়েছিল তারি পরবর্তী ধাপ ছিল আধুনিক সাহিত্য। আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির পথ প্রশস্ত ও মসৃণ করেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগপুরুষ' রাজা রামমোহন রায়।বাংলা গদ্য সাহিত্যের আকাশে এক অসাধারণ পুরুষ, আধুনিকতার অগ্রদূত, ভারতীয় জীবনচেতনার উন্মেষস্বরূপ হলেন রাজা রামমোহন রায়।

রাজা রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের বিকাশে লেখনী ধারণ করেননি। বাংলা গদ্যে তাঁর অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল সমাজ সংস্কার ও সমাজ সচেতনতা। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন সমাজ সংস্কারক নবজাগরণের অগ্রদূত। সতীদাহ প্রথা নিবারণকল্পে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল বাংলা গদ্য ভাষা। 



রামমোহনের লেখাগুলি প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।-

প্রথমতঃ ধর্ম ও তত্তগত আলোচনা

বেদান্তগ্রন্থ , বেদান্তসার ,ভট্টাচার্যের সহিত বিচার,গোস্বামীর সহিত বিচার, কবিতাকারের সহিত বিচার, চারি প্রশ্নের উত্তর, পাদরি ও শিষ্য সংবাদ, গুরুপাদুকা,প্রার্থনা পত্র ইত্যাদি।

দ্বিতীয়তঃ সামাজিক আচার ও প্রথা বিষয়ক রচনা

সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ (১ম খণ্ড),সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ (২য় খণ্ড), সুব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার,পথ্যপ্রদান , গৌড়ীয় ব্যাকরণ ইত্যাদি।

রামমোহনের সাহিত্য সৃষ্টি: রামমোহনের সাহিত্য কীর্তির প্রধান উদাহরণ হলো সম্বাদ কৌমুদী। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীল সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। এছাড়াও ছিল বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫); বেদান্তসার (১৮১৫); বিভিন্ন উপনিষদের অনুবাদ ইত্যাদি।

রামমোহনের গদ্য সাহিত্য পর্যালোচনা :-

রামমোহনের রচনা শৈলী ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে করি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন দেওয়ানজী (রামমোহন) জলের ন্যায় সহজ ভাষায় লিখিতেন, তাহাতে কোনো বিচার ও বিবাদঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতিসহজ স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাটা ও প্রাদুশ মিষ্টতা ছিল না।

রামমোহন ব্রহ্মবাদী বলে একেশ্বরবাদের অর্থ তাঁর মূলমন্ত্র ছিল। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন বেকন, নিউটন, ভলতেয়ার, রুশো প্রভৃতি মনীষীদের রচনাও মনে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি তাঁর সংগৃহীত জ্ঞান অবলম্বনে বেদান্ত ও উপনিষদের অনুবাদ করেন। ১৮১৫-তে প্রকাশিত হয় 'বেদান্তগ্রন্থ'।

সমস্ত জীবন ধরে রামমোহনকে শাস্ত্র ব্যাখ্যা আর লেকচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল।

কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার', 'গুরুপাদুকা', 'অনুষ্ঠান' এসব গ্রন্থগুলি অতি সংক্ষিপ্ত। ব্রহ্মসঙ্গীত নামে একটি গ্রন্থে প্রায় ৩২টি রামমোহনের লেখা গান সংকলিত আছে। বিবেক-বৈরাগ্য, ব্রহ্মবন্দনা প্রভৃতি এদের বিষয়।

রামমোহনের বিশেষ কৃতিত্ব 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' রচনায়। বইটিতে রয়েছে ৪টি অধ্যায় উচ্চারণ শুদ্ধি, লিপি শুদ্ধি, পদবিধান, লিঙ্গ-বচন। এই বইতে তদ্ভব ও দেশী শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার আছে।

3.বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান আলোচনা করো।


উত্তর:


ভূমিকা:

বাংলা সাহিত্যে ধারাবাহিক পদ্য রচনার সূত্রপাত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর লেখকদের মাধ্যমে। বিশৃঙ্খল গদ্য রূপ রীতি কে শৃংখলাবদ্ধ সামঞ্জস্য বিধানে ফোর্টউইলিয়াম কলেজ এর অবদান ছিল অবিস্মরনীয়। ফোর্টউইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের লেখালেখিতেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশ ঘটে এবং সঠিক সু পথে চালিত হয়।

কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য:

এদেশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর দেশ শাসনের প্রয়োজনে ইংল্যান্ড থেকে আনা হল সিভিলিয়ানদের। কিন্তু তারা এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার আচরণ এমনকি এ দেশের ভাষার সঙ্গে ছিল অপরিচিত। অথচ এসব না জানলে মানুষদের সঙ্গে কথা না বললে দেশ শাসন করা দুঃসাধ্য। তাই বিলেত থেকে আসা তরুণ সিভিলিয়ানদের এই সমস্ত বিষয় শিক্ষাদানের জন্য তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি (১৮০০) খ্রিস্টাব্দে কলকাতা লালবাজার 'কলেজ অফ ফোর্ট উইলিয়াম' প্রতিষ্ঠা করলেন।

বাংলা গদ্যসাহিত্য বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতদের অবদান:

বাংলা ভাষা শেখানোর কোন পাঠ্যপুস্তক না থাকায় উইলিয়াম কেরির তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত, ফারসি, আরবি জানা পন্ডিত মনীষীদের দিয়ে বাংলা গদ্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে প্রয়াসী হলেন। বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে সেইসব পন্ডিতরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ক) উইলিয়াম কেরী: উইলিয়াম কেরি একজন বিচক্ষণ ভাষাবিদ পন্ডিত ছিলেন। ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা ছাড়াও কেরির উল্লেখযোগ্য দুটি গদ্য রচনা কথোপকথন ও ইতিহাস মালা।

খ) রামরাম বসু: ফোর্টলিয়াম কলেজ এর অন্যতম পন্ডিত রামরাম বসু বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্বের বিশিষ্ট রচয়িতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর রচিত প্রধান দুটি গদ্য গ্রন্থ রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র ও লিপিমালা।

গ) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার:- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক মন্ডলীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। কলেজের পণ্ডিতদের মধ্যে পাণ্ডিত্য, মনীষা ও ওদার্যে মৃত্যুঞ্জয় শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্বে তিনি একজন যথার্থ শিল্পী তাঁর রচিত রচনাগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল

বত্রিশ সিংহাসন: বত্রিশ সিংহাসন এর গল্পের মূল ইতিহাস ও জনশ্রুতি। আদর্শ রাজা বিক্রমাদিত্যের চরিতকথা ও মহানুভবতা বর্ণনা এই ৩২টি গল্পের উদ্দেশ্য। রাজা বিক্রমাদিত্যের নিঃস্বার্থ পরোপকারী চরিত্র বর্ণনার জন্য গল্প রচিত হয়েছিল।

হিতোপদেশ: এই অনুবাদগ্রন্থ পশু পাখির মুখে অবিকল মানুষের ভাষা বসিয়েছেন তিনি। কোথাও কৌতুক, কোথাও উপদেশ, কোথাও নিছক বর্ণনা গ্রন্থটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। তিনি মনে করেছিলেন সাধু বাংলা গদ্যের রীতির জন্য সংস্কৃতের আদর্শ অনুসরণ করা উচিত।

রাজাবলি: হিন্দুযুগ, মুসলমান শাসক ও ইংরেজ আমলের ইতিহাস অবলম্বনে রচিত রাজাবলি। বর্ণনাভঙ্গি সহজ এবং জটিলতা বর্জিত তবে বাক্যরীতি সংস্কৃত অনুসরণে তৈরি।

প্রবোধ চন্দ্রিকা: প্রবোধ চন্দ্রিকা মৃত্যুঞ্জয়ের অন্যতম রচনা। গ্রন্থটি মূলত সংকলন গ্রন্থ। সংস্কৃত ব্যাকরণ, অলংকার, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতি থেকে মৃত্যুঞ্জয় নানা ধরনের উপাখ্যান ও রচনারীতি সংগ্রহ করেছেন। সেই সঙ্গে লৌকিক কাহিনীর সন্নিবেশে গ্রন্থটি রচিত। গ্রন্থটিতে কথ্যরীতি, সাধুরীতি, এবং সংস্কৃতানুসারী রীতি তিনটি রীতিই লক্ষ্য করা যায়।


গদ্য সাহিত্য বিকাশে পন্ডিত মনীষীদের অবদান:


বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিবর্তনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

১. বাংলা গদ্যের জড়ত্ব মুক্তিতে তাদের প্রয়াস অনেকটাই সফল। বাংলা গদ্যের মান নির্ণয়ে তারা সহায়ক হয়েছিলেন।

২. ইতিহাস ও গল্প রচনায় তারা পারদর্শীতা দেখিয়ে ছিলেন।

৩. অনুবাদ সাহিত্যেও তাদের পাণ্ডিত্য লক্ষ করা যায়।

৪. পাঠ্যপুস্তক রচনায় তারা সফল

৫. গদ্য সাহিত্যের সঠিক পথ ও সঠিক দিশা তারাই প্রথম দেখেছিলেন।

বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে, বাংলা গদ্যের গঠনে ফোর্টউইলিয়াম কলেজের পন্ডিতরা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা অস্বীকার করা যাবেনা। শিল্পসম্মত আধুনিক গদ্যের তারাই যথার্থ পূর্বসূরী।


Marks:-6

1.বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান আলোচনা করো।

বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদন দত্ত এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা প্রচলিত নাট্যধারায় অভিনবত্বের আমদানি করেন। বাংলা নাট্যমঞ্চে মধুসূদনের আবির্ভাব কিছুটা আকস্মিকভাবেই। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা 'রত্নাবলী' নাটকের অভিনয় দেখে মধুসূদন বিরক্ত হয়ে নিজেকে বাংলা নাটক রচনায় নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর চেষ্টায় বাংলা নাটকে ইউরোপীয় নাট্যরীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

মধুসূদনের নতকগুলিকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা-

১. পৌরাণিক নাটক:- 

মধুসূদনের প্রথম নাটক  'শর্মিষ্ঠা' (১৮৫৯) । মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতির উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত নাটক। ৫ অঙ্কে রচিত এই নাটকটি। মধুসুদনের জীবদ্দশায় এই নাটকের ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।গ্রীক নাটক 'Apple of Discord অবলম্বনে রচিত পৌরাণিক নাটক হল পদ্মাবতী (১৮৬০)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকেই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।



২. ঐতিহাসিক নাটক:-

  কৃষ্ণকুমারী (১৮৬২) নাটকের বিষয়বস্তু গ্রহণ করা হয়েছে কর্নেল টডের 'রাজস্থান' (Annals and antiquities of Rajasthan) গ্রন্থ থেকে। নাটকের মূল চরিত্রগুলি হল ভীমসিংহ, জগৎসিংহ, কৃষ্ণকুমারী। মোট ৫ অঙ্ক বিশিষ্ট এই নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ও প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি।

৩. রূপক নাটক:- 

মায়াকানন (১৮৭৪) মধুসূদনের লেখা শেষ নাটক । এটি একটি রূপক নাটক। এই নাটকটি পাঁচ অঙ্কে বিন্যস্ত।  মূল চরিত্রগুলি হল অজয়, ধুমকেতু, রামদাস, ইন্দুমতী, শশিকলা। নাটকটি ১৮৭৪ সালের ১৮ এপ্রিল বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়।

৪. প্রহসন:- 

 বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) মধুসূদনের লেখা একটি প্রহসন । এই নাটকের পূর্বনাম 'ভগ্ন শিবমন্দির'।  ইয়ং বেঙ্গলদের প্রতি ব্যঙ্গ করে একেই কি বলে সভ্যতা?' (১৮৬০) এই প্রহসনটি রচিত হয়।প্রহসনটির প্রথম অভিনয় হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই শোভাবাজার নাট্যশালায়। পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকোথিয়েটারেও এর অভিনয় হয়েছিল।

মূল্যায়ন :-

কেবল বাংলাকাব্য ক্ষেত্রেই নয়, নাট্যসাহিত্যেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। সমকালীন নাট্যধারার দুর্বলতাকে মনে রাখলে মধুসূদনের নাট্যকৃতির প্রশংসা করতেই হয়। মধুসূদনের পূর্বে বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীর নাটক তখনও কেউ লেখেননি।ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই লেখেন-"এই দুখানি প্রহসন থেকেই দেখা যাবে মধুসুদন নানা ধরনের বাংলা, মায়া উপভাষা-কতটা জানা ছিল, আর জনজীবনের সঙ্গে তিনি কতটা নিবিড় ভাবে পরিচিত ছিলেন।" বস্তুত মধুসুদন যদি আর একটিও নাটক না লিখতেন তবে এই প্রহসন দুটিই নাট্যকার মধুসূদনের কৃতিত্ব বিচারে যথেষ্ঠ হত। আধুনিক রীতির নাটক রচনা করে মধুসূদন পরবর্তী নাট্যকারদের নাটক রচনায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনায়, ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় এবং প্রহসন রচনায় মধুসূদন নাট্য ক্ষেত্রেও বিচিত্র প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন।

2.Q: বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আলোচনা করো।

ভূমিকা:

বাংলা নাট্য সাহিত্যে মধুসূদনের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব। মাইকেল মধুসূদনের সৃষ্টিতে যে নাটকের সার্থক প্রকাশ ঘটে দীনবন্ধু তাকে আরো পূর্ণ ও বিকশিত করে তোলেন। তিনি মাইকেল- যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তো অবশ্যই, আধুনিক কালেও তাঁর মর্যাদা ও মহিমা কমেনি। বিশেষত নীলদর্পণ' নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি যে প্রতিবাদী জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন আজও তা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। সমসাময়িক সামাজিক জীবনের উজ্জ্বল আলেখ্য হিসাবে তার নাটক গুলির স্বতন্ত্র মর্যাদা রয়েছে।

দীনবন্ধুর প্রথম নাটক নীলদর্পণ' (১৮৬০) নীলকরদের অত্যাচারের ওপর ভিত্তি করে লেখা প্রায় সত্য কাহিনীর রূপায়ণ। সে সময় নীলকররা বাংলার কৃষকদের জোর করে নীলচাষ করাত। নীলের চাষে চাষীদের কোনো লাভ হত না, তাছাড়া দাদনের টাকা বাকি বকেয়া শোধ ইত্যাদিতে তারা অত্যন্ত পীড়িত হত এবং দেনা ও ঋণসমেত চুক্তির বোঝা তাদের পুরুষানুক্রমে বহন করতে হত। নীলকরেরা তাদের স্বজাতীয় ইংরেজ শাসক এবং গ্রামের দারোগা দেওয়ান প্রমুখের সাহায্যে চাষীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাত। যখন তখন শ্যামচাদের বাড়ি পড়ত চাষীদের পিঠে, তাদের নীলকুঠীতে বন্দী করে রেখে পীড়ন করা হত, এমন কি হত্যাও করা হত, চাষীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত, তাদের বৌ- ঝিদের ওপর অত্যাচার করা হত, জালজুয়াচুরি প্রতারণা করে চাষীদের ওপর চুক্তির দায়িত্ব দেওয়া হত। সব কিছুর প্রতিবাদে কোনো চাষী আইনের দ্বারস্থ হলে নীলকর সাহেবদের সহযোগী বিচারকরা শেষটুকুও নিঃশেষ করে দিত। বাংলার চাষীরা নীলকরদের ভয়ে ভীত ও সংকুচিত হয়ে থাকত। এরই বিরুদ্ধে দীনবন্ধু মিত্র সরব হলেন, নীলকরদের অত্যাচারের বীভৎস ও নির্মম চিত্র তিনি অঙ্কন করলেন নীলদর্পণ' নাটকে, দেশের জনমত জাগ্রত হল মানুষ প্রতিবাদে মুখর হল, মাইকেল মধুসূদনের করা ইংরেজী অনুবাদ ইংল্যান্ডে পৌঁছলে সেখানকার মানুষরাও জানতে পারলেন এই বীভৎস প্রথার কথা। পরিণামে নীলচাষ প্রথা বন্ধ হয়। বাংলার চাষীরা এই মহাসংকট থেকে রক্ষা পায়।

শ্রেষ্ঠ নাটক: তার রচিত শ্রেষ্ঠ প্রহসন গুলি হল-

(ক) সধবার একাদশী (১৮৬৬) :-

সধবার একাদশীর বিষয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে  কলকাতার উচ্চশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের পানাসক্তি, লাম্পট্য, পরস্ত্রীহরণ প্রভৃতি চরিত্রভ্রষ্টতার কাহিনি। 'সধবার একাদশী'র শ্রেষ্ঠ গুণ-এর একান্ত বাস্তব ও অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় কথাবার্তা। কথোপকথনের ভঙ্গিও আকর্ষণীয়। চরিত্র চিত্রণও স্বাভাবিক। 

(খ) বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬):

বিয়ে পাগলা বুড়ো' মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রৌ' প্রহসনের অনুসরণে রচিত। এই প্রহসনে বিবাহ বাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের অকাল পরিপক্ক ছেলেরা কিভাবে নাস্তানাবুদ করেছিল তারই কৌতুককর দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে।

বিয়ে পাগলা বুড়ো' নিখুঁত হাস্যরসপ্রধান প্রহসন হিসাবে একটি অপূর্ব সৃষ্টি। এর মধ্যে ধারালো কথার তীব্র ঝালক নেই। কোন গভীর সমাজ সমস্যার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও নেই। হাস্যরসের অনর্গল ধারায় প্রহসনটি আগাগোড়া স্নিগ্ধ ও মধুর।

(গ) জামাই বারিক (১৮৭২): -

জামাই বারিক' প্রহসনটি সমাজের বাস্তব সমস্যা অবলম্বনে রচিত। পূর্বে কুলীন জামাইরা নিষ্কর্মা ও বেকার অবস্থায় শশুরবাড়িতে থাকত। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য শ্বশুরের উপর নির্ভর করতে হত বলে তারা সকলের কাছে হাস্যাস্পদ হত। এদের করুণ অবস্থা ও দুঃখের কথা দরদী নাট্যকার হাস্যরসের অনাবিল স্রোতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। সপত্নী-ঈর্ষা, কলহপীড়িত দ্বিপত্নীক স্বামীর সমস্যা প্রহসনে আলোচিত। দীনবন্ধুর প্রহসনগুলির মধ্যে হাস্যরসের প্রাবলা 'জামাই বারিকে সবচেয়ে বেশি।

(ঘ) লীলাবতী (১৮৬৭):-

দীনবন্ধুর পরিণত ভাবনার ফসল। নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতে ঘটনার দ্বন্দ্বে নাটকটি সার্থক। নাটকের বিষয় প্রেম, প্রেমের বিলাস ও বৈচিত্র্য নাটকে আছে। ব্রাহ্ম আন্দোলন ও স্ত্রীশিক্ষার প্রতি লেখকের পক্ষপাত স্পষ্ট। আগের নাটকের মতো কৌলীন্যপ্রযার অনিষ্টকর দিকটিও নাটকে দেখানো হয়েছে।দীনবন্ধুর শেষ নাটক 'কমলে কামিনী' (১৮৭৩০) যাতে ইতিহাসকে আনা হয়েছে ও ঐতিহাসিক গম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টির চেষ্টা আছে। কৌতুকরসের প্রকাশও কম নেই। তবু নাটক হিসেবে এটি উচ্চমানের।

3.কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান লেখ।


আধুনিক বাংলা সাহিত্য যার উপর ভিত্তি করে বিকাশ লাভ করেছে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার মূল পরিচয় কবি হিসাবে হলেও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি অবাধে পদচারণা করেছেন। বাংলা কবিতা, বাংলা নাটক, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য, বাংলা পত্রসাহিত্য, বাংলা ভ্রমণসাহিত্য, বাংলা গান প্রভৃতিতে তিনি উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন। 


কাব্য সাহিত্য

সাহিত্যিক প্রতিভা বহুমুখী হলেও বাংলা কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অবদান গৃহীত হয়েছে। কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের অন্তরের সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভূতিকে যে রূপ দিয়েছেন এবং নিজের অন্তরের সর্বোচ্চ আধান্তিক চেতনাকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন তার প্রতিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রথম যুগের কবিতা সংকলন 'মানসী' (1890) ও 'সোনার তরী' (1893) তার এই দুইখানি গ্রন্থে এই কবিতাগুলি যেমন অভিনব তেমনি অপূর্ব রস স্বাদ পূর্ণ মানুষের মনে যে সব সুখ দুখ আশা আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা ভাবনা প্রভৃতির স্রোত অনবরত প্রভাবিত হয়। তা ভাষায় প্রকাশ করতে না পারায় মানুষ একটি অব্যক্ত বেদনা অনুভব করে। তার প্রকাশ বেদনা নামক কবিতায় তিনি মানুষের চিন্তা ভাবনা গুলি তুলে ধরেছেন।


রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতায় অতি উচ্চ স্তরের দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। মানবিক ভাববেগ বিস্তারের মাধ্যমে তিনি বহিপ্রকৃতিকে নতুন রূপে পরিচিতি দেওয়ার জন্য পুরানো পটে, নতুন নতুন ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটি দার্শনিক আধ্যানিক অনুভবেরও পরিচয় দিয়েছেন। 'মানসী' এবং 'সোনার তরী' এই দুটি গ্রন্থে কবি কল্পনার রাজ্য ছেড়ে সংসারের দুঃখময় বাস্তব জীবনের রূপ তুলে ধরেছেন তার ফলে কবির বাস্তববাদী মন যে নতুন আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছে তা 1896 সালে প্রকাশিত 'চিত্রা' নায়ক গ্রন্থের 'এবার ফিরাও মোরে' কবিতাটির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। এটি রবীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট জীবনে কেবল কবিতায় নয়, সমগ্র সাহিত্যিক রচনার উৎস ও প্রধান প্রেরণা বলে মনে করা যেতে পারে।

1913 সালে গীতিকাব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ জগতবিখ্যাত 'নোবেল পুরস্কার' লাভ করে বিশ্ব সাহিত্যে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদার অধিকারী করে তুলেছিলেন। কিন্তু কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগে রবীন্দ্রনাথের দান অমূল্য ও অপরিসীম। এছাড়াও গীতি কবিতার সহিত ছোট গল্পেরও কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।


4.বাংলা কাব্য কবিতার ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান ও ভূমিকা লেখ ?

ভারতবর্ষ পরাধীন। পরাধীন ভারতবর্ষে তখন চলেছে উত্তাল মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রাম। গান্ধীজীর নেতৃত্বে একের পর এক বিপ্লব ঘটে চলেছে এদেশে। অসহযোগ আন্দোলন সারা বাংলা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। ঠিক সেই সময়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বিদ্রোহের বাণী নিয়ে বাংলা কাব্য জগতে আবির্ভূত হলেন নজরুল। সমসাময়িক যুগ চেতনায় তাঁর কাব্যের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের প্রতি তার বিদ্রোহ। বিদ্রোহই এ দেশের জমিদার, মালিক ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে। এদের অত্যাচারের কাছেই খুঁজে পেলেন তার কাব্যের ভাষা। তবে তার এ বিদ্রোহ মূলত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। নজরুল এসেই যে বিদ্রোহের বাণী সঞ্চারিত করে দিলেন তার তেজ ভবিষ্যতে কখনো স্তিমিত হয়ে পড়েনি। তাই রবীন্দ্রনাথের পর বর্তমান কাব্য আন্দোলনের মধ্যে সঠিকভাবে কেউ যদি কবিতার মোড় ঘুরিয়ে থাকেন তিনি হবেন নজরুল। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করেছেন: "সব কটা জানালা খুলে নূতনের হাওয়া প্রথম যিনি সবেগে বইয়ে দিলেন, তিনি নজরুল ইসলাম, নজরুলের ছিল দৃপ্ত কণ্ঠস্বর।

কাজী নজরুল ইসলামের রচিত কাব্য গ্রন্থ:

অগ্নিবীণা (১৯২২), ভাঙার গান (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), ফণিমনসা (১৯২৭), চক্রবাক্ (১৯২৯), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), সিন্ধুহিন্দোল (১৯২৭), প্রলয়শিখা (১৯৩০) ইত্যাদি।



কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের পটভূমি:

ঘটনাবহুল নজরুলের জীবনের মতোই তাঁর কাব্যের পটভূমিও বৈচিত্র্যময়। বিষয় বৈচিত্র্যে ও কল্পনায় নজরুলের কবিতা সমৃদ্ধ তাঁর কবিতা সমূহকে সাধারণভাবে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। ১। বিষয় নিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান। ২। ব্যক্তিনিষ্ঠ ও কল্পনা প্রধান। প্রথম পর্যায়ের কাব্য কবিতার মধ্যে সমাজ; সমাজের আর্থ রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যা, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, অভিযোগ, স্বদেশ, যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশুদ্ধ Lyric বা কবি মনের ভাব উচ্ছ্বাস, ব্যক্তিময়তা বা মৃন্ময়ভাব প্রাধান্য পায়। যদি নজরুলের সমগ্র কাব্য কবিতাকে সঠিক বিশ্লেষণের দ্বারা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিভাজন করা যায় তাহলে কয়েকটি বিভাগ বেশ প্রকট হয়ে ওঠে-

1) বিদ্রোহ ও সমাজ ভাবনা: 

নজরুলের বস্তুনিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান কবিতাগুলির মধ্যে বিদ্রোহী, ফরিয়াদ, সাম্যবাদী,অন্ধস্বদেশ, দেবতা, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এইসব কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও বিদ্রোহের দীপ্তি ও দাহ যুগমানসের বৈশিষ্ট্য রূপে প্রকাশ লাভ করেছে। আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় তিনি স্পষ্টই বলেছেন:

"প্রার্থনা করো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস। 

যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।"

2) প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক:

বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কবিতার মধ্যেই নজরুলের কবি প্রতিভা শুধু আবর্তিত হননি। 'বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি' গানের আড়াল, আমি গাই তার গান প্রভৃতি কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির অপূর্ব সমাহার অনুভব করা যায়। যেমন বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি কবিতায় কী আশ্চর্য সুন্দর প্রেম চেতনা আত্মপ্রকাশ করেছে:

নিশীথিনী যায় দূর বনছায় তদ্রায় ঢুলুঢুলু।

3) শিশু বিষয়ক:

কাজী নজরুল বেশ কিছু শিশু বিষয়ক কাব্য কবিতা নাটক রচনা করেছেন। তার 'খুকুও কাঠবিড়ালী', 'প্রভাতী', 'লিচুচোর', 'ঝুমকো লতায় জোনাকী', 'মটকু মাইতি', 'বাঁটকুল রায়', 'ঘুমপাড়ানি গান', 'আমি যদি বাবা হতাম', 'বাবা হত খোকা', 'সাত ভাই চম্পা', 'শিশুর জাদুকর' ইত্যাদি কবিতাগুলি এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। খুকুর চোখে কাঠ বিড়ালীর যে জীবন্ত অবয়ব ফুটে উঠেছে তা সত্যই চমৎকার:

"দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট?

আমায় দেখে যাও।।"

কাঠবিড়ালী। তুমি মর?

তুমি কচু খাও।। 

4) সঙ্গীত বিষয়ক:

গান রচনায় নজরুল 'স্বরাজ্যে স্বরাট'। তারই রচিত গান নজরুল গীতি নামে পরিচিত। তিনি আগমনী বিজয়া, রাম শ্যাম বা কৃষ্ণ, চৈতন্য শঙ্কর দুর্গা, সরস্বতী বন্দনামূলক, মহাপুরুষ বন্দনা, বৈষ্ণব ভাবমূলক, হাস্য রসাত্মক, গজল, মারফতী-মর্শিদ, জারি, সারি, ঝুমুর, খেয়াল ঠুংরী, বাউল, কাজরী, ভাটিয়ালী শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করে সাঙ্গীতিক প্রতিভার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।


5.বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।

বাংলা কথা সাহিত্যের জগতে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি রবীন্দ্রনাথের স্বকীয়তাকে মেনে নিয়েও সাহিত্যে নতুন কথা শোনালেন। শরৎচন্দ্র জানালেন

"সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না, সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছু অধিকার নাই...."

শরৎচন্দ্র তাঁর সমকালে সামাজিক সমস্যাগুলিকে উপলব্ধি করেছিলেন খুব কাছে থেকেই। তাই জীবনের সমস্যাগুলিকে তিনি বেশি করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্বে দায়ী সমাজ। তবে একথা ঠিকই তিনি সমাজকে দায়ী করলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও সমাধানের পথ দেখাননি। 

শরৎচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে 'বড়দিদি' (১৯১৩), 'পরিণীতা' (১৯১৪), 'পণ্ডিতমশাই' (১৯১৪), 'বিরাজ বৌ (১৯১৪), মেজদিদি' (১৯১৫), 'চন্দ্রনাথ' (১৯১৬), 'পল্লীসমাজ' (১৯১৬), 'অরক্ষণীয়া' (১৯১৬), 'শ্রীকান্ত' (প্রথম) (১৯১৭), 'দেবদাস' (১৯১৭), 'নিষ্কৃতি' (১৯১৭), 'চরিত্রহীন' (১৯১৭), 'দত্তা' (১৯১৮), 'শ্রীকান্ত' (দ্বিতীয়) (১৯১৮), 'বামুনের মেয়ে' (১৯২০), 'গৃহদাহ' (১৯২০), 'দেনাপাওনা' (১৯২৩), ইত্যাদি। শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস 'বড়দিদি' ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং শেষ উপন্যাস 'বিপ্রদাসে'র রচনাকাল ১৯৩৫। তবে মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় 'শুভদা' (১৯৩৮) এবং 'শেষের পরিচয়' (১৯৩৯)।

তাঁর প্রথম উপন্যাস 'বড়দিদি'তে জমিদারের অত্যাচারের কাহিনি বর্ণিত হলেও সমাজনিষিদ্ধ বিধবার প্রেম সমস্যা এবং মাধবীর স্নেহ-ভালোবাসা-ই মুখ্য স্থান গ্রহণ করেছে।শরৎচন্দ্রের 'পল্লীসমাজ' উপন্যাসের দুটি দিক-একদিকে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর সমকালীন পল্লীজীবনের সামাজিক চিত্র ও ভাবী সমাজতান্ত্রিক সমাজের পূর্বাভীষ এবং অন্যদিকে এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে রমা ও রমেশের হৃদয়ের দ্বন্দ্ব নিপুণ তুলিতে অঙ্কিত। 'চন্দ্রনাথ' উপন্যাসে রয়েছে সনাতন আদর্শের প্রতিফলন। 

শরৎচন্দ্র কোনো সামাজিক নীতিবোধকে স্বীকৃতি দেননি, বরং এর বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে সমাজশক্তি ছিল প্রবল। সেজন্য সে সময়ে সমষ্টি জীবনের দাবি ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শরৎচন্দ্র মনে করেন, সমাজশক্তি বহিঃশক্তিরূপে ব্যক্তিজীবনের অগ্রগতি বা ব্যাপ্তিকে বাধা দেবে এটা তিনি মেনে নিতে চাননি। নারীর সতীত্ব ও নারীত্ব-এ দুটোকে আলাদা করে তিনি দেখতে চেয়েছেন। শরৎচন্দ্র বরাবরই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি নাস্তিক ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্য, শিব ও সুন্দরের উপাসক। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলি মূলত সমাজের উচ্চস্তরের। সে তুলনায় শরৎচন্দ্র সমাজের সাধারণ স্তরের ক্ষুদ্র স্নেহ, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ নারী চরিত্রগুলিকে এঁকেছেন তাঁর উপন্যাসে। 

6.বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান লেখ।

বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন করে মেজাজ ও ভঙ্গির প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তোলার প্রয়াস যিনি একমাত্র করেছিলেন তিনি হলেন 'সবুজ পত্র'র সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী। তিনি প্রবন্ধের মধ্যে মজলিশি আলাপের সুর, খেয়াল-খেলার লীলায়িত ছন্দ, ভারমুক্ত স্বচ্ছন্দ মনন সঞ্চরণের প্রবর্তন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধে মাঝেমাঝে হালকা চাল থাকলেও প্রমথ চৌধুরীর আলোচনা গাম্ভীর্যপ্রধান ও গভীর সুরে অনুরণিত। এছাড়া তার তীক্ষ্ণযুক্তি, লঘু কল্পনা ও স্বচ্ছন্দচারী খেয়াল প্রভৃতির মাধ্যমে যে পরিমণ্ডল রচনা করেছেন তা একান্ত প্রমথ চৌধুরীর মতোই।

তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি হল 'তেল-নুন-লকরি' (১৯০৬), 'বীরবলের হালখাতা' (১৯১৭), 'নানাকথা' (১৯১৯), 'দুইয়ারকি' (১৯২০), 'আমাদের শিক্ষা' (১৯২০), 'বীরবলের টিপ্পনী' (১৯২১), 'রায়তের কথা' (১৯২৬), 'নানাচর্চা' (১৯৩২), 'প্রাচীন হিন্দুস্থান' (১৯৪০), 'আত্মকথা' (১৯৪৬)।

প্রমথ চৌধুরীর গদ্য ও প্রবন্ধশৈলীর বৈশিষ্ট্যগুলো হল -

১। সাহিত্যের ভাষাকে তিনি মুখের ভাষার অনেক কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। সাহিত্যের তথাকথিত সাধুভাষা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, 'তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোনো স্থান নেই।'

২। প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যে চলিত ভাষার পক্ষপাতী হলেও তাঁর গদ্যরীতিকে 'মৌখিক গদ্যরীতি' বলা চলে না। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'শুধু ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম ছাড়া প্রমথ চৌধুরী আর কোনো দিক দিয়ে মুখের ভাষার বিশেষ অনুকরণ করেননি, বরং অনাবশ্যক মারপ্যাঁচ, বাচনভঙ্গির অকারণ তির্যকতা, ও অলঙ্কারের চাকচিক্য তাঁর চলিত ভাষাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধু ভাষার চেয়েও দুরূহ করে তুলেছে।

৩। ভাষা এবং সাহিত্য দু'রকমের রচনাই তিনি লিখেছেন। ভাষা বিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -'বঙ্গভাষা বনাম বাবু বাংলা ওরফে, সাধুভাষা', 'কথার কথা', 'আমাদের ভাষাসঙ্কট', 'সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা', 'বাংলা ব্যাকরণ' ইত্যাদি। সাহিত্যবিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-'সাহিত্যে চাবুক', 'সাহিত্যে খেলা', 'কাব্যে অশ্লীলতা' ইত্যাদি। ভাষা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, 'ভাষামার্গে আমি ভারতচন্দ্রের পদানুসরণ করেছি। সাহিত্য কেন্দ্রিক রচনাগুলিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ সুলভ দৃষ্টি এবং পরিহাস প্রবণতা যুক্ত হয়েছে।

৪। কথকতা সুলভ ভঙ্গি, চলিত ভাষা প্রয়োগ, বাগবৈদগ্ধতা, ব্যাঙ্গ ও পরিহাস প্রবণতা তাঁর গদ্যসাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

৫। প্রমথ চৌধুরীর গদ্যকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'ইস্পাতের ছুরি'। তিনি আঙ্গিকের কাঠিন্যতা থেকে প্রবন্ধ সাহিত্যকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রবন্ধে তিনি বিষয় নিয়ে খেলা করেছেন এবং খেলার আনন্দ উপভোগ করেছেন।

৬। মুখের কথাকে তিনি শিল্পকলায় রূপান্তরিত করেছেন।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে প্রাবন্ধিক হিসাবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব রেখে গেছেন। যদিও অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, "যথার্থ মুখের ভাষাকে সাহিত্যকর্মে ব্যবহারের গৌরব হুতোম ও বিবেকানন্দের প্রাপ্য, প্রমথ চৌধুরীর নয়।"-তবুও তাঁর ভাষারীতির স্বাতন্ত্র্য আছে, সেই স্বাতন্ত্র্য কৃত্রিম হলেও তাকে সাহিত্যে যথাযথ স্থান করে দেওয়ায়, বাবৈদগ্ধ্যপূর্ণ ভাষার ব্যবহারে, বাঙালি মনন ও সংস্কৃতি'কে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তিদান করে, প্রমথ চৌধুরী চলিত রীতির বাংলা গদ্যের যে নতুন সন্ধান দিয়েছেন এবং প্রবন্ধে আঙ্গিকের যে পরিবর্তন এনেছেন সেজন্য প্রাবন্ধিক হিসাবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Marks:-3

1.নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান  লেখ।

ভূমিকা :

দীনবন্ধু মিত্রের পরবর্তী কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১) বাংলা নাট্য জগতকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ নাট্যকার ও প্রয়োগশিল্পী। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাঙালী দর্শক সর্বপ্রথম প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিল। প্রথমে অভিনেতারূপে আত্মপ্রকাশ করে তিনি অন্যের লেখা নাটক অভিনয় করতেন, পরে নিজেই নাট্য রচনা শুরু করেন।

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক :

গিরিশচন্দ্র ঘোষের পূর্ণাঙ্গ নাটকের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশখানা, এছাড়া প্রহসন, পঞ্চরং রূপক রঙ্গব্যঙ্গের নাটক ও অনুরূপ। এই প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্রের সমস্ত নাটকগুলিকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন –

(ক) গীতিনাট্য :

গিরিশচন্দ্র নাটক রচনায় মনোনিবেশ করে সর্বপ্রথম কয়েকটি গীতিনাট্য রচনা করেন। আগমনী , প্রাক্‌প্রতিমা , অকালবোধ , দোললীলা এগুলি সমস্তই অভিনয়ের দ্বারা দর্শক মাঝে আলোড়ন তুললেও এগুলি সাহিত্যরস সৃষ্টিতে ব্যাহত হওয়ায় পরবর্তীকালে এই সকল নাটকের অভিনয় আর হয়নি বললেই চলে।

(খ) পৌরাণিক নাটক :

অভিমন্যুবধ , রাবণবধ , নল-দময়ন্তী , জনা প্রভৃতি নাটকের মধ্যে পুরাণের বিষয়ে বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ আশা কামনার সঙ্গে একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই মিশে গেছে রচনার গুণে ।

গ) পৌরাণিক ভক্তিরসের নাটক :

এই শ্রেণীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল (ক) চৈতন্যলীলা (১৮৮৪) (খ) বিশ্বমঙ্গল (১৮৮৮) ইত্যাদি। কেবলমাত্র ভক্তি রসকেই আশ্রয় করেই এই পর্বের নাটকগুলি রচিত।

ঘ) ঐতিহাসিক নাটক :

বিংশ শতকের পাদলগ্নে সমগ্র ভারতবর্ষ যখন দেশীয় ইংরেজ শাসকের অত্যাচারে উত্তাল।সেই প্রেক্ষাপটে গিরিশচন্দ্র ঘোষ কয়েকটি ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে রচনা করলেন স্বদেশ প্রেমের নাটক। যেমন – সিরাজদ্দৌলা , মীরকাশিম , ছত্রপতি শিবাজী , অশোক ইত্যাদি। 

(ঙ) সামাজিক নাটক :

ভক্তি, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক পর্বের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পর গিরিশচন্দ্র আত্মনিয়োগ করলেন সামাজিক নাটক রচনায় যা দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র। গিরিশ চন্দ্র বাস্তবজীবন সম্পর্কে এত তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছিলেন তার সম্যক পরিচয় মেলে এই পর্বের নাটক রচনার গুণ দেখে।প্রফুল্ল , হারানিধি , বলিদান ,মায়াবসান প্রভৃতি নাটক ।

মূল্যায়ন :

চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নায়ক-নায়িকা অন্তর্দ্বন্দ্ব, জীবন সম্পর্কে গভীর প্রত্যয় তাঁর নাটকে যে ভাবে প্রকাশ পেয়েছে , তাতে তাঁকে অনায়াসে প্রথম শ্রেণির নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । তিনি নিজের হাতে বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি করেছিলেন । 

2. সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তেভাগা আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।

১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যাঁতাকলে ১৫০ বছর ধরে জোতদার-জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণের শিকার হতে হয়েছে কৃষককে। মাঝেমাঝে কৃষকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও সর্বাত্মক সংগঠিত চেহারা নিতে পারেনি সেইসব আন্দোলন। বিগত ছয়-সাত বছর ধরে বাংলার ভূমি রাজস্ব কমিশনের ফসলের তিনভাগের দুইভাগ অংশ কৃষকের প্রাপ্য এই মর্মে সুপারিশ নিয়ে টালবাহানার শেষে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সিদ্ধান্ত ক্রমে ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে ফসল কাটার মরশুমে শুরু হয়ে যায় তেভাগার সংগ্রাম। ফসলের তিনভাগের দুইভাগ কৃষকের ও একভাগ জমিদারের এই দাবিতে আন্দোলন। তৎকালীন যুক্ত বঙ্গের ময়মনসিংহ থেকে দক্ষিণে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ১৯টি জেলায় প্রভাব পড়েছিল এই আন্দোলনের।

এই স্বাভাবিকতায় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নানা দিক ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সৃষ্টিতে। এর মধ্যে রয়েছে ছোটো গল্প, কবিতা, গান, চলচ্চিত্র, রিপোটার্জ ইত্যাদি। বিশিষ্ট মনস্বী গোপাল হালদার ওই সময়ের কালজয়ী সৃষ্টির কথাকে গণনায় রেখে একে আখ্যায়িত করেছেন 'মার্কসবাদী রেনেসাঁ' নামে। প্রথমে আসা যাক সাহিত্যের কথায়। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি অমূল্য সৃষ্টি 'হারাণের নাতজামাই' ও 'ছোটো বকুলপুরের যাত্রী'। এই দুটি গল্পকে নিয়ে চলচ্চিত্র ও নাটক সবই হয়েছে। এছাড়াও মানিক বাবু তেভাগার ওপর আরো কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, ননী ভৌমিক, সুশীল জানা, সমরেশ বসু, সৌরী ঘটক, মিহির আচার্য, মিহির সেন, আবু ইসহাক প্রমুখের রচিত অন্তত কুড়িটি গল্প বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের মাধ্যমে তেভাগা আন্দোলনের ধারাকে বহন করে চলেছে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সমরেশ বসুর গল্প 'প্রতিরোধ', সৌরী ঘটকের উপন্যাস 'কমরেড', শিশিরকুমার দাসের উপন্যাস 'শৃংখলিত মৃত্তিকা', আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা', মহাশ্বেতা দেবীর 'বন্দোবস্তী 'ইত্যাদির কথা।

3.গণনাট্য বা নবনাট্য বা সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলন বলতে কী বোঝ ?

গণনাট্য, বা, গণনাট্য সংঘ হলো ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী একটি নাট্যদল যেটি ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে গণনাট্য আন্দোলন শুরু করেছিল বাংলার গ্রামীণ জনপদে সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটকের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে।

গণনাট্য মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নাট্যকর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠায় এটির মূল লক্ষ্য ছিলো তৃণমূলের গণমানুষকে নাট্যকলার মাধ্যমে সচেতন করে নিজেদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা।গণনাট্য আন্দোলন বাংলার নাট্যসাহিত্যের উপর প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এখানকার জনমানসে সাংস্কৃতিক বিকাশও সাধন করেছে।

৩০ ও '৪০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটির সাথে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের প্রায় সকল নাট্যকর্মী এবং অভিনয় শিল্পিগণ।এই সংঘের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ বিজন ভট্টাচার্য,উৎপল দত্ত প্রমুখ।

১৯১৭-১৯৭৮ সাল টা ছিল বিজন যুগ। আধুনিক গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য। নাটকের ইতিহাসে প্রচলিত ধারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তিনি। তাঁর নাটকে ফুটে উঠেছিল ঐতিহাসিক, পৌরাণিক এবং পারিবার-সামাজসহ এক ঝলক মুক্তির আলো এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ। এর আগে বাংলা নাটক উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে বৃহত্তর জনজীবনকে তেমনভাবে ছুঁতে করতে পারেন নি কেউই। বিজন ভট্টাচার্যই সর্বপ্রথম ‘নবান্ন’ (১৯৪৪)-এর মাধ্যমে বাংলার গণজীবনের সঙ্গে নাটকের সুতো বেঁধেছিলেন। তাই বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা চির অমর হয়ে আছে।   

বিজন ভট্টাচার্য নাট্যজীবন শুরু করেন ১৯৪০ এর দশকে। সেই সময় বাণিজ্যিক থিয়েটারের প্রচলিত ধারার বাইরে স্বতন্ত্র নাট্য আন্দোলনের সূচনা করেন কিছু ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক, শিল্পী গোষ্ঠী। তাঁদেরই সাংস্কৃতিক শাখা ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন সেখানকার প্রথম সারির নাট্যকর্মী। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক রচনা, অভিনয় এবং নির্দেশনা এই গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেশ প্রশংসিত হয়।   

4.সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নকশাল আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।

গত শতকের সত্তরের দশক ঠিক আর দশটা দশকের মতো ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। রাইফেল, রেডবুক দিকে দিকে মুক্তি আনছে— এই ছিল আহ্বান। তবে পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ি গ্রামে যা শুরু হয়েছিল, তার তুলনা মেলা ভার! ১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ি জেলায় কৃষকরা সংগঠিত হয়ে ভূস্বামী আর তাদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বারুদ যেন দিয়াশলাইয়ের আগুন পেল, দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে এ কমিউনিস্ট আন্দোলন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের এমন চেহারা এ উপমহাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি। 

শুরুর দিন থেকেই নকশালবাড়ির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগোলো বাংলা কবিতা। কবিরা একদিকে যেমন শব্দে আগুন জ্বালিয়েছেন, তেমনি মাঠের লড়াইয়েও শামিল হয়েছিলেন। কবিরা খুন হয়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন, নির্যাতন সয়েছেন। নকশাল আন্দোলনের কবিতায় স্থান পেয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক আহ্বান, মতবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম, কৃষক সংগ্রামের গাথা। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে দুর্গা মজুমদার সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্র তুলে ধরেছেন তার ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ কবিতায়। কবিতা যেন লড়াইয়ে নামার সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক! সারা জীবন ধূম উদ্গীরণের চেয়ে অন্তত একবারের জন্য হলেও জ্বলে ওঠবার আহ্বান।

“নতজানু হয়ে তিলে তিলে ক্ষয়ে বাঁচবার নাম

আমি রাখলাম

মরণের স্তব—

খুনের বদলে খুন না ঝরিয়ে মরবার নাম

আমি রাখলাম

শ্মশানের শব!

মারার তাগিদে আড়ালে গা-ঢেকে বাঁচবার নাম

আমি রাখলাম

সংগ্রামী গৌরব—

মরণের মুখে থুথু ছুড়ে দিয়ে মরবার নাম

আমি রাখলাম

সশস্ত্র বিপ্লব!!

এর পর কয়েক বছর নকশাল আন্দোলন ধনী, ভূস্বামীদের, পুলিশের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল। সাধারণ ঘরের তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে পড়লেন পার্টির সশস্ত্র আন্দোলনে। নকশাল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাধারণ মানুষের বিপ্লবী রূপান্তর। মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা যে বিপ্লবের জননী, সে গল্প এবার সত্য হয়ে দেখা দিল। দান-খয়রাত নয়, রাষ্ট্রে নিজের অধিকার নিয়ে মানুষের বাঁচতে চাওয়ার দাবি উঠেছিল। আর এ চেতনা মূর্ত হলো ১৯৭৪ সালে স্বপন চক্রবর্তীর লেখা ‘আমাদের গল্প’ কবিতায়—

“আমরা সাহায্য চাইনি

কারণ আমরা বদল চেয়েছি।

চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।

নকশাল আন্দোলনে যুক্ত চারজন তরুণ কবি খুন হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে, জেলখানায় বন্দি অবস্থায়। এদের মধ্যে আছেন কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ, তিমিরবরণ সিংহ, অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও মুরারি মুখোপাধ্যায়। তিমিরবরণ সিংহ ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নকশাল আন্দোলনে গ্রামে গিয়েছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করতে। ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেলে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। অমিয় চট্টোপাধ্যায় বেহালা পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছিলেন। নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে পার্টির কাজ শুরু করেন। গ্রামে কাজ করতেন ‘সাগর’ ছদ্মনামে। গ্রেফতার হয়ে ঠিকানা হয় জেলখানা এবং জেলের অভ্যন্তরেই তাকে হত্যা করা হয়।

5.সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।

তৎকালীন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বাঙালি ছিল সর্বাগ্রগণ্য। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বও ছিল বাঙালির হাতে। এক কথায়, বাঙালি তখন সমগ্র ভারতকে পথ দেখাত। বাঙালির এই প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবে ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন আতঙ্কিত হন। তাঁর মতে, বাংলা ছিল 'অশান্তির উৎস'। রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন বাঙালিকে দুর্বল করে সমগ্র ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাঁর আমলে বাংলাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব কার্যকারী করা হয়। এই সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সমগ্র বাংলা তথা ভারতে যে আন্দোলনের উদ্ভব হয়, তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলন নামে খ্যাত ।১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বা ৩০শে আশ্বিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকারী হয়। সেদিন সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর নেতৃত্বে সেইদিন  এক বিরাট মিছিল গঙ্গা স্নানে যায় এবং স্নানের পর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একে অন্যের হাতে রাখি পরিয়ে দেয়। 

বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের গুরুত্ব কেবলমাত্র জাতীয় ঐক্য আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাস্তবে স্বদেশী আন্দোলন বাংলা সংগীত, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিত্র শিল্প সকল দিকে প্রভাব ফেলেছিল। সুমিত সরকারের মত্রে 'No other phase of our national movement can boast of Cultural accompaniment as rich as Swadeshi' |

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সকল সংবাদ পত্র ও সমসাময়িক পত্র প্রকাশিত হয়েছিল তা বাংলার সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। এই সময় অসংখ্য কবিতা ও গানের মাধ্যমে দেশ প্রেমের বাণী চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের 'বাংলার মাটি বাংলার জল'-ই হোক বা 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' বাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি মুকুন্দ দাসের লেখনীও উল্লেখযোগ্য। কবি ইসমাইল হোসেনের অনল প্রবাহে কাব্যগ্রন্থে হিন্দু ও মুসলিম উভয় জাতিকেই ভারতমাতার সন্তান হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। গ্রাম বাংলার পল্লীগীতি ও বাউল গানের মধ্যেও স্বদেশী বা তার আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল।

এই সময় বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে আত্মশক্তি, ভারতবর্ষ, স্বদেশ সমাজ, শিক্ষা, সমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম চৌধুরির ভারত পত্রিকায় বয়কট ও স্বাদেশীকতা ইত্যাদি নামে কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। অপর লেখকদের মধ্যে দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সখারাম গণেশ দেউস্কর, দেবী প্রসন্ন রায়চৌধুরী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসাবে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ স্থাপিত হয়। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম বাৎসরিক অনুষ্ঠান বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। নিখিলনাথ রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি ঐতিহাসিক আমাদের ইতিহাসের জ্ঞানকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। 



Wednesday, June 12, 2024

Cooch Behar er Bharat Bhukti

 DSE:- 4

1. Discuss the process of merger of the Princely State of Cooch Behar with the State  of West Bengal.


Answer :- ১৯৪৭ সনের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। লর্ড মাউন্ট- ব্যাটনের সুপারিশ অনুযায়ী বৃটিশ পার্লামেন্টে যে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয় তাহার ৮নং ধারা অনুযায়ী দেশীয় রাজাগুলি, ভারত অথবা পাকিস্তান কোন্ রাষ্ট্রে যোগদান করবে  তা নিজেরাই স্থির করতে পারবে । এই বিষয়ে রাজার মত-ই চূড়ান্ত, প্রজাগণের কিছু বলবার  অধিকার  নেই।


এই বিষয় নিয়ে কোচবিহারে বিভিন্ন দল পরস্পর বিরোধী চেষ্টা করেছিল । একদল  কোচবিহার ভারতের সাথে যুক্ত হোক, দ্বিতীয় দল কোচবিহার পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হোক বলে মত প্রকাশ করেন । কোচবিহার প্রথমে ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির পর আবার পশ্চিমবঙ্গ অথবা আসামের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে এই বিষয়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এই সব মত বিরোধের জন্য কোচবিহারের বুকে নূতন এক সমস্যার উদ্ভব হইল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দেশীয় রাজাদের নবগঠিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগদান করার জন্য বিশেষ অনুবোধ জানান। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে  কোচবিহার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একান্ত অনুরোধে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এক Coochbehar Merger Agreement  চুক্তি স্বাক্ষর করে  কোচবিহার রাজ্যটিকে ১৯৪৯ সনে ২৮শে আগস্ট তারিখে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাখার কথা ঘোষণা করেন। এই ইতিহাস-প্রসিদ্ধ দেশীয় রাজাটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্পণ করেন ১৯৪৯ সনের ১২ই সেপ্টেম্বর। চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয় ভারতের গভর্ণর জেনারেলের পক্ষে ভারত সরকারের মিনিস্ট্রী অব স্টেটের উপদেষ্টা ডি. পি. মেনন ও কোচবিহার মহারাজার মধ্যে। এই চুক্তিতে ৯টি ধারা সংযোজিত হয়। 


ভারত সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন দফায় আলোচনা অনুসারে প্রথমে কোচবিহার কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি পায়। পরে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কোচবিহার রাজ্যটিকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই সময়ে কংগ্রেস দলের পক্ষ হইতে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে মিটিং মিছিল আরম্ভ হয় এবং এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে প্রজাহিতসাধনী নামে স্থানীয় একটি দল ব্যাপক আন্দোলন আরম্ভ করে। তৎকালীন পত্র-পত্রিকাগুলিতেও সংযুক্তির বিষয়ে জোরালো মত প্রকাশ করা হয়।  ১৯৫০ সালের জানুয়ারীতেই রাজ্যসরকার-'The Cooch Behar (Assimilation of State Laws) Act-1950, পাশ করেন এবং কোচসরকারের কয়েকটি আইনকে রাজ্যের আইনবিধির অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। ১৯৬০ সালের ৪ঠা মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্রবিভাগের ঘোষণাক্রমে জলপাইগুড়ি বিভাগ পুনর্গঠিত হয় এবং কোচবিহার এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।


উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির পুনর্গঠন:- 

স্বাধীনতার মাশুল হিসেবে প্রাকৃতিক-সীমানাশ্রিত উত্তরবঙ্গ থেকে রংপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহী এই চারটি পূর্ণ জেলাই শুধু পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হ'ল না, সেই সঙ্গে অবশিষ্ট ৫টি উত্তরবঙ্গীয় জেলার অঙ্গচ্ছেদও করা হলো। রাডক্লিফ' সাহেবের উপর পড়ে ছিল এই সীমানা-নির্ধায়ণের ব্যাপারটা এবং তিনি তার জটিল ও দুর্বোধ্য পদ্ধতিতে বেভাবে জেলাগুলিকে ভাগ করেছেন, তা মূলতঃ একতরফা শাসকীয় সিদ্ধান্ত। উত্তরবঙ্গের প্রত্যেকটি জেলারই বিভাজন  হওয়ায় জেলার সীমানার পুননির্ধারণ এবং প্রশাসনিক পুনর্বিন্তাস প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

Saturday, February 24, 2024

ঠান্ডা লড়াই

 3) ঠান্ডা লড়াই কাকে বলে ? এর পটভূমি লেখো ? এর বৈশিষ্ঠ্য ও  তৃতীয় বিশ্বে ঠাণ্ডা লড়াই এর প্রভাব আলোচনা করো ।

উত্তর:-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে একদিকে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অপরদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য গড়ে তোলার জন্য এই দুই রাষ্ট্রজোটের মধ্যে যে লড়াই শুরু হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত ।

■  ঠান্ডা লড়াইয়ের পটভূমি:-

a) চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা : ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার মিসৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনে ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরোপীয় সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন । 

b) কেন্নানের বেষ্ঠনী নীতি :- রাশিয়ায় কর্মরত  মার্কিন রাষ্ট্রদূত জজ এফ . কেরান  সোভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বেষ্টনী তত্ত্ব ' ( Da89.8 জুলাই ) প্রকাশ করেন , যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয় ।

c) ট্রুম্যান নীতি :- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতায় ( ১৯৪৭ খ্রি . ১২ মার্চ ) তুরস্ক ও গ্রিস - সহ বিশ্বের যে - কোনো দেশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন , যা ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত । ঐতিহাসিক আইজ্যাক ভয়েসচার ঈমান নীতিকে ঠাণ্ডা লড়ায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বলে অভিহিত করেছেন । 

d ) আমেরিকার শক্তিজোট গঠন : - সোভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলে ' উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা ' ( NATO ) | তারপর একে একে গড়ে তোলে ' দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ' ( SEATO ) ; ' মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা ( MEDO ) যা  পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা ' ( CENTO ) নামে পরিচিত হয়। 

e) রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিজোট গঠন : আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে- ওঠা পশ্চিমি সামরিক শক্তিজোট ন্যাটোর জবাবে রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা ( Warsaw Pact Organisation , WPO ) , যা ছিল একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ।

■ ঠান্ডা লড়াইয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-

 1 ] কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব :-  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে  Super Power রাষ্ট্ররূপে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের । তাই ঠান্ডা লড়াই বলতে বোঝায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সারা বিশ্বে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে । 

 2 ) সমর্থন লাভের দ্বন্দ্ব :-  উভয় রাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ও তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করতে তৎপর ছিল । 

3 ) মতাদর্শের সংঘাত :-  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও সাম্যবাদের পক্ষে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় । এর পরিণতি হিসেবে ঠান্ডা লড়াই নামে রাজনৈতিক মতবাদের লড়াই শুরু হয় । 

4 ) সামরিক শক্তির দ্বন্দ্ব :-  কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কেন্দ্র করে দুই শক্তিজোট ভিতরে ভিতরে জোর সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে । প্রবল থেকে প্রবলতর শক্তিসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরি ও সেগুলির পরীক্ষার নামে যুদ্ধ মহড়া শুরু হয় দুই শিবিরে । এইভাবে উভয়পক্ষই প্রবল সামরিক বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে । বিশ্বে আতঙ্কজনক বাতাবরণ গড়ে ওঠে , যা ঠান্ডা লড়াই নামে অভিহিত হয় । 

 5 ) ছায়া যুদ্ধ : আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কোনো পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নেয়নি । কেবল যুদ্ধের আবহ বজায় রেখেছিল ।

■  তৃতীয় বিশ্বে ঠাণ্ডা পড়াইয়ের প্রভাব :-

[ 1 ] ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে ছড়িয়ে পড়া : দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলেই ঠান্ডা লড়াই পরিবেশের উৎপত্তি । কিন্তু ওই দুই শক্তি কখনোই নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি । অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবত থেকে দূরে সরে থাকা কিন্তু সম্ভব হয়নি |

 [ 2 ] আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে জাপান , ফ্রান্সও ব্রিটেনের আধিপতা বিলুপ্ত হয়েছিল । এর ফলে এশিয়া মহাদেশের এক বিশাল অংশে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল , তা পূরণের লক্ষ্যে এগিয়েছিল ধনতান্ত্রিক আমেরিকা বা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া উভয় দেশই | ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের যে সূত্রপাত ইউরোপে হয়েছিল , তা ওই দুই মহাশক্তির হস্তক্ষেপে এবার এশিয়া মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ল । তৃতীয় বিশ্বও তা থেকে রক্ষা পেল না ।

Sunday, January 21, 2024

ট্রুম্যান নীতি ও ভারত ছাড়ো

 7. ট্রুম্যান নীতি কী ? মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল ? 4 + 4 

ট্রুম্যান নীতি : গ্রিস , তুরস্ক ও ইরানে রুশ অনুপ্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিলে ওই দেশগুলিকে রুশ প্রভাব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান গ্রিস ও তুরস্কসহ বিশ্বের যে - কোনো দেশে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন । এই ঘোষণা ' টুম্যান নীতি ' নামে পরিচিত ছিল । 

 সোভিয়েত বিরোধিতা : প্রেসিডেন্ট রুজভেন্টের উত্তরসূরি ছিলেন ট্রুম্যান রুজভেল্ট সোভিয়েত রাশিয়ার সাঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলেও ট্রুম্যান রুজভেল্টের উত্তরসূরি হয়েও সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর বিরোধিতা করতে থাকেন । তিনি সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভকে তাঁর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন । তাই মলোটভ বলেছিলেন । যে , এই ধরনের ভৎসনা তিনি সারা জীবনে পাননি । 

ফুলটন বক্তৃতা চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি প্রদেশের ফুলটনের ওয়েস্ট মিনিস্টার কলেজে এক বক্তৃতায় বলেন যে সাম্যবাদ মানবসভ্যতার কাছে চ্যালের স্বরূপ । তাই সোভিয়েত আগ্রাসী নীতিকে রুখতে ইন্দো - মার্কিন যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । 

 ট্রুম্যান নীতির লক্ষ্য 1947 খ্রিস্টাব্দে 12 মার্চ মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ' ট্রুম্যান নীতি ' ঘোষিত হয় । ট্রুম্যান তাঁর ভাষণে বলেন , যে সকল দেশ সশস্ত্র সংখ্যালঘিষ্ঠ অথবা বাহ্যিক শক্তির আধিপত্য স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে আমেরিকার কর্তব্য সেই সকল জনগোষ্ঠীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া । 

সমালোচনা ডি . এফ . ফ্রেমিং টুম্যান নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন । তিনি এটিকে Effective Dec Jaration of War ' বলেছেন । ট্রুম্যান ঘোষণার ফলে এমন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ' চাপ ' এবং পাল্টা চাপ ' ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে না এই নীতির যারা সমালোচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জোসেফ জোনস , ওয়াল্টার লিপম্যান প্রমুখ ।

 মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য জন মার্শাল 1947 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে মার্কিন নীতি ব্যাখ্যা করেন । তাই তার নাম অনুসারে এটি মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত । কতকগুলি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মার্শাল পরিকল্পনা প্রয়োগ করা হয়েছিল , এগুলি হল-

 ( 1 ) যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো , যাতে তারা সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাবাধীন । না হয়ে পড়ে ।

 ( 2 ) সাহায্যপ্রাপ্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিকে সাহায্যদানকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য সুনিশ্চিত করা।

 ( 3 ) সাহায্যপ্রাপ্ত ইউরোপীয় দেশগুলি নিয়ে একটি রাষ্ট্রজোট গঠন করা , যার মাধ্যমে সোভিয়েত রাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিরোধ করা যায় । 

( 4 ) পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বার্থপূরণের উপযুক্ত বাজার গড়ে তোলা । পরিশেষে বলা যায় যে , মার্শাল পরিকল্পনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল দয়া দেখিয়ে সাম্যবাদের ভিত্তি ধ্বংস করা ।

1942 সালের ভারতছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে নিবন্ধ লেখো । অথবা , ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো । 

উত্তর সূচনা : জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বশেষ ও সর্বভারতীয় আন্দোলন ' ছিল । 1942 - এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন । গান্ধিজি পরিচালিত এই আন্দোলন ছিল সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । 

প্রস্তাব গ্রহণ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অশান্ত ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে 1942 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সমিতির অধিবেশনে ' ভারত ছাড়ো ' প্রস্তাবে বলা হয় যে শুধু ভারতের মঙ্গলের জন্যই নয় , ফ্যাসিবাদ , নাৎসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান এবং বিশ্বের নিরাপত্তার জন্যও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান একান্ত জরুরি । এই প্রসঙ্গে গান্ধিজি ঘোষ করেন করেছেন করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে ।

 • ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা : 1942 খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট রাতে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির অধিবেশনে বিপুল ভোটে ভারতছাড়ো প্রস্তাব পাশ হয় । ঘোষণা করা হয় 9 আগস্ট থেকে সারাভারতে ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত ছাড়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে । কিন্তু ৪ আগস্ট মধ্যরাতে গান্ধিজি , জওহরলাল , প্যাটেল , জে বি কৃপালনি সহ শীর্ষনেতাদের ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করলে পরদিন সকালে সারাভারত গণবিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে । 

ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিস্তার : কোনো শীর্ষনেতা ছাড়াই জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে । 

প্রথমত , বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এই আন্দোলন সবথেকে তর আকার ধারণ করে । তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে । এছাড়াও কলকাতা , ঢাকা , হুগলি সহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ।

 দ্বিতীয়ত , বিহারের মুঙ্গের ভাগলপুর , মুজাফ্ফরপুর , যুক্তপ্রদেশের আজমগড় , জৌনপুর , গোরক্ষপুর প্রভৃতি জেলায় গান্ধিজির “ করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে ” ধ্বনি জনগণকে স্বাধীনতালাভে ব্যাকুল করে । 

তৃতীয়ত , বোম্বাই আমেদাবাদ , পুনা প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পানি কটক , বেনারস প্রভৃতি স্থানে আন্দোলনকারীরা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় । 

আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ : ভারতছাড়ো আন্দোলনে গান্ধিজির ডাকে যাঁরা দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ , অরুণা আস আলি , সুচেতা কৃপালনি , অজয় মুখার্জি সুশীল ধাড়া প্রমুখ । এছাড়াও আসামের 13 বছরের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ও মেদিনীপুরের তমলুকের 73 বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনি হাজরা ছিলেন । উল্লেখযোগ্য ।

ব্যর্থতার কারন :- 

উপযুক্ত নেতৃত্বের অনুপস্থিতি : ভারত ছাড়ো আন্দোলন গান্ধিজির একক নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল ছিল । কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার পরই গান্ধিজি সহ কংগ্রেস শীর্ষ নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়েছিল । গান্ধিজির অবর্তমানে আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব সেসময় দেশে ছিল না ।

 তাঁর দমন নীতি । এই আন্দোলন দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তীব্র দমননীতি অনুসরণ করেছিল । দৈহিক নির্যাতন , গ্রেফতার , ঘর পুড়িয়ে দেওয়া , গুলি চালানো কোনো কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি । 

অন্যান্য দলের বিরোধিতা : কমিউনিস্ট দল ভারত ছাড়ো আন্দোলন মেনে নেয়নি । আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা ব্রিটিশকে মদত দেয় । মুসলিম লিগ - সহ অন্য দলগুলিও কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি 

অ সময়ে সূচনা 1939 খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলন শুরু করার পক্ষপাতী ছিলেন । আর গান্ধিজি আন্দোলনের ডাক দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে । সেসময় ইংল্যান্ড যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল ।

মর্লে- মিন্টো সংস্কার ও নৌবিদ্রোহর

 5.  1909 খ্রিস্টাব্দের মর্লে- মিন্টো সংস্কার আইনের সমালোচনামূলক আলোচনা করো । 

ভারত সচিব জন মর্লে এবং বড়োলাট মিন্টো কংগ্রেসের নরমপন্থী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে এবং  নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী করতে চেষ্টা করেন।  পাশাপাশি  কংগ্রেসবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লিগকে খুশি করার জন্য 1908 খ্রিস্টাব্দের 1 অক্টোবর ভারতের শাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি খসড়া আইন পেশ করেন । 1909 খ্রিস্টাব্দে এটি আইনের রূপ পায় , যা কাউন্সিল আইন বা মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন ( 1909 ) নামে পরিচিত হয় । 

■ আইনের বিভিন্ন দিক : মলে - মিন্টো সংস্কার আইনের দুটি প্রধান দিক– কার্যনির্বাহক পরিষদ ও আইন পরিষদ ।

● কার্যনির্বাহক পরিষদঃ-  কেন্দ্র ও বিভিন্ন প্রদেশে কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়— 

i) বড়োলাটের কার্যনির্বাহক পরিষদে এই প্রথম একজন ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত হয় এবং প্রথম ভারতীয় সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ । 

ii)বোম্বাই ও মাদ্রাজের কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে 2 থেকে 4 করা হয় । 

iii) বাংলার ছোটোলাটের জন্য তৈরি হয় একটি কার্যনির্বাহক পরিষদ ।

● আইন পরিষদ : মর্লে - মিন্টো আইন দ্বারা কেন্দ্র ও প্রদেশে আইন পরিষদ গঠন ও ক্ষমতা বিষয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয় । 

i)  কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে 16 থেকে 60 করা হয় । 

ii ) প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে 50 জনের মধ্যে রাখা হয় ।

iii)  কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলি বাজেট তৈরি , বাজেট পাস , বাজেট সম্পর্কে আলোচনা ও ভোটদানের অধিকার পায় ।

iv ) আইন পরিষদ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায় ।

v)  মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেয় ।

vi )  গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরগণ তাদের অপছন্দের যে - কোনো সদস্যকে আইনসভা থেকে অপসারণের অধিকায় পায় ।

● আইনের ত্রুটি:-

a)  এই শাসনসংস্কার আইন দ্বারা কেন্দ্র কিংবা প্রদেশে কোনো দায়িত্বশীল শাসনব্যকথা গড়ে ওঠেনি । 

b) এই আইনের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোনো ক্ষমতা বা মতামতের গুরুত্ব ছিল না ।

c )  দেশীয় রাজ্য , সামরিক বিভাগ , বৈদেশিক নীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোনো প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভার ছিল না ।

d )  এই আইনানুসারে গভর্নর জেনারেলই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী । আইনসভার যে - কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ , বাতিল করার অধিকারী ছিলেন তিনি । 

e ) এই আইনে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের কথা বলা হয়েছিল , যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদে আঘাত হানে । 

f ) এই আইনের দ্বারা কংগ্রেসের চরমপন্থী গোষ্ঠীকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয় , অন্যদিকে নরমপন্থীদেরও আশা - আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হয়নি । 

● গুরুত্ব:-  এই আইন ভারতের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল । এই আইনের দ্বারাই প্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় । এই আইনের দ্বারা বড়োলাটের শাসন পরিষদে একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করে সরকারি প্রশাসনে ভারতীয়দের যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয় ।  এই সংস্কার আইন ভারতে সাংবিধানিক রীতিনীতি প্রচলন ও আইনের শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে ।

6. Ans নৌবিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব লেখো । 

ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়  অভ্যুত্থান ছিল রয়্যাল ইন্ডিয় নেভির ধর্মঘট যা নৌবিদ্রোহ নামে ভারত ইতিহাসে খ্যাত । সুমিত সরকার লিখেছেন " ব্রিটিশদের সবচেয়ে  বড়ো ত্রাস অবশ্যই ছিল 1946 খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ ।

●  নৌবিদ্রোহের কারণ :-  1946 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের ভারতীয় নৌবাহিনীতে ব্যাপকভাবে  বিদ্রোহ ঘটেছিল তার পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল । যথা—

A)  খাদ্যগত বৈষম্য : ভারতীয় নাবিকদের নিকৃষ্টমানের খাদ্য সরবরাহ করা হত । কিন্তু ইংরেজ সেনারা উচ্চমানের খাদ্য পেত । ফলে ভারতীয় নৌসেনা , কর্মী এবং অফিসারদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাধে।

 B) জাভিগত বিদ্বেষ:- ইংরেজ নাবিক ও নৌ - অফিসাররা ভারতীয় নাবিক ও নৌ - অফিসারদের যথেষ্ঠ ঘৃনার চোখে দেখত । এ ছাড়া ভারতীয় নাবিকদের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহারও করা হত । ফলে ভারত নাবিক ও সেনারা ইংরেজদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে ।

C) ব্রিটিশ অফিসারদের খারাপ ব্যবহার : নৌসেনাবাহিনীতে জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ইংরেজ নৌঅফিসাররা ভারতীয় নৌসেনাদের অকারণে গালিগালাজ , অপমান ও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত । এই বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতীয় নৌসেনাদের মনে অসন্তোষের জন্ম দেয়।

D ) বেতন বৈষম্য : সমযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌসেনাদের কখনোই ব্রিটিশ নৌসেনাদের সমপরিমাণ বেতন দেওয়া হতো না । ব্রিটিশ সরকারের এই বেতন বৈষম্য ভারতীয় নৌসেনাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল । 

E ) পদোন্নতি না করানো : নৌবাহিনীতে ভারতীয় নৌসেনাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ ছিল না । এমনকী চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না । 

F ) আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার : ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ভারতীয় নৌসেনাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল । এবং তাদের বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে । আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মত্যাগ এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য এই বাহিনীর সংগ্রাম নৌসেনাদের নতুন দিশা দেখায় ।

বিদ্রোহের প্রসার : ভারতীয় নৌবাহিনীর মধ্যে উপারার কারণে বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি হয়েছিল । 1946 খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ে তলোয়ার জাহাজে ভারতীয় নৌসেনাগণ বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটায় । কিছুদিনের মধ্যেই এই বিদ্রোহ  কলকাতা , করাচি , কোচিন , মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে । ভারতীয় নৌসেনিওরা বিদ্রোহটি পরিচালিত করার জন্য ' কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি ' গড়ে তোলে ।

গুরুত্ব :- নৌবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল ঠিকই , তার এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ।

এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে শুধু সাধারণ মানুষ নয় ভারতীয় নৌসেনারাও তাদের চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছে । 

এই বিদ্রোহের ফলে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় । এই বিদ্রোহে হিন্দু - মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হয়েছিল ।

এই বিদ্রোহের ফলে ভারতীয় নৌসেনা ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যবধান হ্রাস পায় এবং তারা একত্রে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে যোগদান করে । 

জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয় শীর্ষগানীয় রাজনৈতিক দলই এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল । কেবলমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের থেকেই বিদ্রোহীরা সমর্থন পেয়েছিল । শীর্ষস্থানীয় দলগুলি জাতীয় আন্দোলনের প্রসারের তুলনায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রেই অধিক মনোযোগী ছিল ।

ভূমিরাজস্ব ও নবজাগরন

 3. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও । 

উত্তর:- 1765 খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ডক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন । পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর - জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে , রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন । 

■ কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা :- 

● পাঁচসালা বন্দোবস্ত :- 1772 খ্রিস্টাব্দে বাংলার গভর্নর থাকার সময় হেস্টিংস তাঁর কাউন্সিলের চারজন সদস্যকে নিয়ে একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন করেন । এই কমিটির দায়িত্ব ছিল জমির ইজারাদার নিয়োগের । সর্বাধিক রাজস্ব প্রদানে সম্মত ইজারাদারকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য জমি ইজারার দায়িত্ব দেওয়া হত । সর্বাধিক রাজস্ব দিতে ব্যর্থ ইজারাদারের কাছ থেকে জমি কেড়েও নেওয়া হত । পাঁচ বছরের জন্য বলবৎ এই ব্যবস্থাটিকে পাঁচসালা বন্দোবস্ত বলা হত । 1772 থেকে 1777 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকে । এই ভূমি বন্দোবস্তের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল— 

কালেক্টর নিয়োগ:-  পূর্বে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার দেখাশোনা করত সুপারভাইজার নামক এক শ্রেণির কর্মচারী হেস্টিংস ওই কর্মচারীদের নতুন নামকরণ করেন কালেক্টর কালেক্টরদের নির্দিষ্ট কতগুলি দায়িত্ব পালন করতে হত । 

রাজস্ব বোর্ড ( Board of Revenue ) গঠন :- ভ্রাম্যমাণ কমিটি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে ফলশ্রুতিস্বরূপ হেস্টিংস এই কমিটিকে বাধ্য হয়ে বাতিল করেন সঠিকভাবে রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য 1773 খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি রাজস্ব বোর্ড ( Board of Revenue ) গঠন করেন । 

আমিনি কমিশন গঠন : রাজস্বের ব্যাপারে সঠিক তথ্যসংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে হেস্টিংস 1776 খ্রিস্টাব্দে আমিনি কমিশন গঠন করেন । 

● একসালা বন্দোবস্ত :-  পাঁচসালা বন্দোবস্তে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়ায় হেস্টিংস 1777 খ্রিস্টাব্দে এটি বাতিল করে দেন । পরিবর্তে এক বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন । নতুন এই জমি বন্দোবস্ত প্রথাটি পরিচিত হয় একসালা বন্দোবস্ত নামে । 1277 খ্রিস্টাব্দে চালু হওয়া ব্যবস্থাটি 1779 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলবৎ থাকে । এই জমি বন্দোবস্তের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক হল— একসালা বন্দোবস্তে কোনো জমিদার যদি রাজস্ব বাকি রাখতেন তাহলে সেই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের উপায় নির্দিষ্ট থাকত । সেক্ষেত্রে এই জমিদারের জমিদারির একাংশ বিক্রি করে তাকে রাজস্ব প্রদান করতে হয় এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট জমির অধিকারী হতেন পুরোনো জমিদাররাই । 

●  দশসালা বন্দোবস্ত:-  জন শোরের বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে কর্নওয়ালিশ 1789 খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও বিহারে এবং  উড়িষ্যায় দশ বছরের জন্য জমি দেওয়ার প্রথা চালু করেন , যা দশসালা বন্দোবস্তা নামে পরিচিত হয় । এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন যে ব্রিটেনের পরিচালক সত্তা অনুমোদন দিলে এই দশ বছর মেয়াদি বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী করা হবে ।

● চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত :- 1794 খ্রিস্টাব্দে বাংলা , বিহার ওড়িশায় লর্ডকর্নওয়ালিস  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন । মার্শম্যান এর মতো অনেকে এই ব্যবস্থার সাফল্যের কথাও বলেছেন । অপরদিকে হোমস - এর মতো কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই ভূমি বন্দোবস্তের বেশকিছু ত্রুটি তুলে ধরেছেন । 

● সুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল । এর সুফলগুলি হল— 

(A) এই ভূমি বন্দোবস্তের ফলে কৃষির উন্নতি ঘটে এবং কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণও বৃদ্ধি পায় । 

(B)  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সরকারের বার্ষিক আয় সুনির্দিষ্ট হওয়ায় বাজেট প্রস্তুতিতে সুবিধা হয় । 

(C) জমিদাররা নির্দিষ্ট খাজনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগ করার অধিকার পান । 

(D) এর ফলে নতুন জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে , যারা ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ সমর্থকে পরিণত হয় ।

● কুফল :-চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল অপেক্ষা ফল ছিল অনেক বেশি । সেগুলি হল-- 

(A) জমির গুণাগুণ বিচার করে যে রাজস্ব ধার্য করা হত তার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি । 

(B ) সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব জমা না দিলে তাদের জমিদারি হারাতে হত । 

(C ) অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে কৃষকরা মহাজনদের কাছে সুদে টাকা  নিতে বাধ্য হত । এভাবেই গরিব কৃষকরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে । 

(D ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম প্রধান কুফল  হল পাত্তনি প্রথা এবং পাত্তনিদার নামক এক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব । 

● রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত :- দক্ষিণ ও দক্ষিণ - পশ্চিম ভারতের বেশকিছু অঞ্চলে ইংরেজ কোম্পানির শাসন । প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানকার ভূমিবন্দোবস্তু সম্পর্কে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয় যার ফলস্বরূপ 1820 খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় প্রশাসক আলেকজান্ডার রিড এবং স্যার টমাস মনরো রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন ।

এই ব্যবস্থায় রায়তদের জমির ওপর স্থায়ী অধিকার থাকত না । দীর্ঘমেয়াদি শর্তে তারা 20-30 বছরের জন্য জমি ভোগদখলের অধিকার পেত । রায়তওয়ারি ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলি হল— রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষিযোগ্য জমিগুলিকে প্রথমে জরিপের ব্যবস্থা করা হত । তারপর সেগুলিকে উৎপাদন ক্ষমতা ও উর্বরতা অনুযায়ী এটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে কৃষকাদের মধ্যে বণ্টন করা হত ।

● মহলওয়ারি বন্দোবস্ত:- 1822 খ্রিস্টাব্দে গাঙ্গেয় উপত্যকা , উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং মধ্যভারতের বেশকিছু অঞ্চলে মহলওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়েছিল । নতলওয়ারি ব্যবস্থায় কয়েকটি গ্রাম নিয়ে তৈরি হওয়া মহল বা তালুকের ওপর রাজস্ব নির্ধারিত হত । এক্ষেত্রেও জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত 20-30 বছরের জন্য । এই বন্দোবস্তের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল— ইজারা প্রদান নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদানের শর্তে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে সরকার কোনো নির্দিষ্ট মহল বা অঞ্চলের ইজারা দিত । ইজারা প্রাপক গ্রামের প্রধান বা মহলের কৃষকদের থেকে রাজস্ব আদায় করে সরকারকে দিত ।

এ ছাড়াও কোম্পানি নানা ধরনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যেমন , ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত পাঞ্জাবের কিছু অঞ্চলে চালু করা হয় । পরীক্ষানিরীক্ষা করে , যাতে সর্বোচ্চ রাজস্ব , ভারতের বিপুল চাষি - জমি থেকে জোগাড় করা যায় , সেই লক্ষ্য পূরণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎপর ছিল।

4. বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি আলোচনা করো । এর সীমাবদ্ধতা কী ছিল ? 

 নবজাগরণ :- উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা , ধর্মীয় উদারতা , সমাজসংস্কার , আধুনিক সাহিত্যের বিকাশ প্রভৃতি শুরু হয় । ফলে ঊনবিংশ শতকে বাংলার সমাজ- সংস্কৃতিতেও ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে । এই অগ্রগতিকে কেউ কেউ উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ' বলে অভিহিত করেছেন ।

 নবজাগরণের প্রসার : উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতি বা নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা । কলকাতা থেকে এই অগ্রগতির ধারা পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে রাজা রামমোহন রায়ের সময়কে এই জাগরণের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয় রামমোহন , বিদ্যাসাগর , কেশবচন্দ্র , দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ।

বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি:-  পঞ্চদশ শতকে সংঘটিত ইউরোপের নবজাগরণের সঙ্গে অনেকে উনিশ শতকে সংঘটিত বাংলার নবজাগরণের তুলনা করেছেন । এর ফলে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ।

(A ) সীমিত পরিসর :- ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ব্যাপ্তি বা পরিসর ছিল খুবই সীমিত । তা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক , বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক । কলকাতার বাইরে গ্রামবাংলায় এই নবজাগরণের প্রসার ঘটেনি এবং গ্রামবাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই নবজাগরণের কোনো সুফল পায়নি ।

(B ) মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধতা :-  বাংলার জাগরণ শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল । বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই সমাজের লোকেদের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক ' বলে অভিহিত করেছেন এজন্য অধ্যাপক অনিল শীল এই জাগরণকে এলিটিস্ট আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন । 

(C ) ব্রিটিশ নির্ভরতা :- বাংলার এই জাগরণ অতিমাত্রায় ব্রিটিশ - নির্ভর হয়ে পড়েছিল । ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন যে , ব্রিটিশ শাসনের দ্বারাই ভারতীয় সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে ।

(D ) হিন্দু জাগরণবাদ:- বাংলার নবজাগরণ প্রকৃতপক্ষে ‘ হিন্দু জাগরণবাদের পর্যবসিত হয় । রাধাকান্ত দেব , মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের কার্যকলাপে হিন্দু জাগরণবাদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায় । আবার , রামমোহন ও বিদ্যাসাগরও হিন্দুশাস্ত্রকে ভিত্তি করেই সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন । 

● নবজাগরণ মতবাদের বিতর্ক :- 

পহ্মে :- ঐতিহসিক যদুনাথ সরকার , সুশোভন সরকার প্রমুখ উনিশ শতকের অগ্রগতিকে নবজাগরণ ' বলে স্বীকার করে নিয়েছেন ।স্যার যদুনাথ সরকার তার হিস্ট্রি অব বেঙ্গল ' গ্রন্থে উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে নবজাগরণ ' বলে স্বীকার করে নিয়েছেন ।ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন , ' ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড়ো উপহার হল আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ । 

বিপক্ষে :- নবজাগরণ ' অভিধার বিপক্ষে অশোক মিত্র , বিনয় ঘোষ , সুপ্রকাশ রায় , ড . বরুণ দে , ড . সুমিত সরকার প্রমুখ উনিশ শতকে বাংলার বৌশিক অগ্রগতিকে নবজাগরণ ' বলে স্বীকার করেন না । অশোক মিত্র সেন্সাস রিপোর্টে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ' তথাকথিত নবজাগরণ " বলে অভিহিত করেছেন ।

সীমাবদ্ধতা :

(i )  ইটালির ফ্লোরেন্স নগরী ইউরোপের নবজাগরণে যে ভূমিকা পালন করে বাংলার কলকাতা তা করতে পারেনি ।

(ii) ফ্লোরেন্সের মতো স্বাধীন মানসিকতা ও শিল্পীমন কলকাতার ছিল না । 

(iii) উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক । কৃষক - শ্রমিকসহ সমাজের একটি বড়ো অংশ এই নবজাগরণের অংশ হতে পারেনি । 

(iv) বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত বর্ণহিন্দুদের । মুসলিম সমাজ এর বাইরে ছিল । 

(v) বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তারা বাংলার সমাজকাঠামো , ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান , জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করেনি ।