CBPBU MEJOR 2 BENGALI
Marks:- 10
১) বাংলা গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) অবদান আলোচনা করো ।
বাংলা গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) অবদান :-
বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় ভাষাশিল্পী ও শিক্ষাব্রতী হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রামমোহনের পথ বেয়ে উনিশ শতকে তার গদ্যচর্চার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়। বছর আটেক গ্রামের স্কুলে পড়াশোনার পর কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের মল্লিকের বসতবাটি সংলগ্ন এক প্রাণমারি স্কুলে ঈশ্বরচন্দ্র ভর্তি হন। ১৮২৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। এখানে অল্প দিনের মধ্যেই ঈশ্বরচন্দ্র মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন।
১৮৪১ সালে বিদ্যাসাগর উপাধি প্রাপ্ত ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করার পর বাংলা ভাষার অধ্যাপনার জন্য এই কলেজে যে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেখানে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলেজের প্রথম পণ্ডিতের স্থানে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইউরোপীয় কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শেখানো ছিল প্রধান পণ্ডিতের কাজ।
প্রথমেই প্রাচীন সংস্কৃত বইগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণের দায়িত্ব নেন। শুধু ব্রাহ্মণ, বৈদ্যই নন সকলের জন্য পড়ার ব্যবস্থা করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের রীতির ও পরিবর্তন করেন। পাশাপাশি সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেন।
বাংলা গদ্য সাহিত্য ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরে অবদান বড়ো কম নয়। বাংলা গদ্যকে একটা নিজস্ব রূপ দেওয়ার তিনি চেষ্ট করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা গদ্যের মাধুর্য ও গাম্ভীর্য। বিদ্যাসাগরের রচনা সমূহকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়-
১ অনুবাদ ও অনুবাদমূলক রচনা,
২ শিক্ষামূলক রচনা,
৩ সংস্কারমূলক রচনা,
৪ মৌলিক রচনা,
৫ বেনামী রচনা।
১ অনুবাদ ও অনুবাদমূলক রচনা:-
অনুবাদক যদি সৃজনশীল হন তাহলে তাঁর কর্মের ক্ষেত্রেও মৌলিকত্বের ছাপ পড়ে। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। তাঁর সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থগুলো ছিল হিন্দি, ইংরেজি ও সংস্কৃতের অনুবাদ। অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম কথা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করেছিলেন। অনুবাদ জাতীয় রচনার মধ্যে তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ 'বেতালপঞ্চবিংশতি'। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ সালে। এরপর লেখা হয় কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'-এর বাংলা অনুবাদ 'শকুন্তলা' (১৮৫৪)। এরপর ১৮৬০ সালে ভবভূতির 'উত্তররামচরিত' ও বাল্মীকির রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে লেখা হয় অনুবাদ মূলক রচনা 'সীতার বনবাস'। লঙ্কা বিজয়ের পর রামের পরবর্তী জীবন ও সীতার জীবনের যন্ত্রণাময় পরিসমাপ্তি নিয়েই এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের জীবিতকালেই বইটির পঁচিশবার সংস্করণ হয়।
২ শিক্ষামূলক রচনা:-
শুধু অনুবাদ নয় যুগের প্রয়োজনে ও তাগিদে তাঁকে পাঠ্যপুস্তকও রচনা করতে হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে পাঠক সমাজে যাতে উচ্চাঙ্গের রস পরিবেশন করতে পারেন সেইকথা ভেবেই তিনি লেখেন 'বর্ণপরিচয়', 'কথামালা', 'বোধোদয়' ইত্যাদি। পদের মধ্যে দিয়ে সহজ সরল কথাভাষায় বিবৃতিতে তিনি যে উপস্থাপন কৌশল দেখিয়েছেন তা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার
৩ সংস্কারমূলক রচনা:-
এছাড়া উল্লেখ করতে হয় বিদ্যাসাগরের বিতর্কমূলক গ্রন্থগুলো; যা সেসময় সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই রচনাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' দুটি খণ্ড যা প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে। শাস্ত্রীয় বচন এর মধ্য দিয়েই বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সুকৌশলে আপন বিনয়কে বজায় রেখে নিজে মত প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের রচনার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট হল তিনি তর্ক বিতর্ক করেছেন নানারকম যুক্তির মধ্য দিয়ে।
৪ মৌলিক রচনা:-
বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'। এরপরে উল্লেখ বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'বিদ্যাসাগর চরিত' (১৮৯১)। গ্রন্থটির মাত্র দুটি পরিচ্ছেদ লেখার পরেই বিদ্যাসাগর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বইটি পুত্র নারায়ণচন্দ্র 'বিদ্যাসাগর চরিত' নাম দিয়ে প্রকাশ করেন।
৫ বেনামী রচনা।:-
এখানেই শেষ নয় বিদ্যাসাগর বেনামে পাঁচটি রচনা প্রকাশ করেছিলেন। কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য ছদ্মনামে তিনি রচনা করেছিলেন 'অতি অল্প হইল' (১৮৭৩) এবং 'আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩)। এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে বিদ্যাসাগর বেনামে তৎকালীন পণ্ডিত তারানাথ তর্ক বাচস্পতিকে বহুবিবাহ রহিত বিষয়ক জবাব দিয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী রচনাও ছদ্মনামে রচিত এর নাম 'ব্রজবিলাস' (১৮৮৫) ।
মূল্যায়ন:-
বিদ্যাসাগর শুধু বাংলা গদ্যের বাহক নন, ধারক হয়েও রয়ে গেছেন আমাদের মধ্যে। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী। বিদ্যাসাগর এর পূর্বে বাংলা গদ্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও বাংলা গদ্যকে তার জটিলতা, আড়ষ্টতা থেকে মুক্ত করে এক মৌল পথ দিয়েছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। এইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন 'বিদ্যাসাগরের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই।'
2.বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো
মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য যেভাবে পুরানো রীতি - সংস্কৃতি ত্যাগ করে নতুন ধারায় পুষ্টি পেয়েছিল তারি পরবর্তী ধাপ ছিল আধুনিক সাহিত্য। আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির পথ প্রশস্ত ও মসৃণ করেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগপুরুষ' রাজা রামমোহন রায়।বাংলা গদ্য সাহিত্যের আকাশে এক অসাধারণ পুরুষ, আধুনিকতার অগ্রদূত, ভারতীয় জীবনচেতনার উন্মেষস্বরূপ হলেন রাজা রামমোহন রায়।
রাজা রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের বিকাশে লেখনী ধারণ করেননি। বাংলা গদ্যে তাঁর অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল সমাজ সংস্কার ও সমাজ সচেতনতা। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন সমাজ সংস্কারক নবজাগরণের অগ্রদূত। সতীদাহ প্রথা নিবারণকল্পে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল বাংলা গদ্য ভাষা।
রামমোহনের লেখাগুলি প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।-
প্রথমতঃ ধর্ম ও তত্তগত আলোচনা
বেদান্তগ্রন্থ , বেদান্তসার ,ভট্টাচার্যের সহিত বিচার,গোস্বামীর সহিত বিচার, কবিতাকারের সহিত বিচার, চারি প্রশ্নের উত্তর, পাদরি ও শিষ্য সংবাদ, গুরুপাদুকা,প্রার্থনা পত্র ইত্যাদি।
দ্বিতীয়তঃ সামাজিক আচার ও প্রথা বিষয়ক রচনা
সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ (১ম খণ্ড),সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ (২য় খণ্ড), সুব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার,পথ্যপ্রদান , গৌড়ীয় ব্যাকরণ ইত্যাদি।
রামমোহনের সাহিত্য সৃষ্টি: রামমোহনের সাহিত্য কীর্তির প্রধান উদাহরণ হলো সম্বাদ কৌমুদী। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীল সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। এছাড়াও ছিল বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫); বেদান্তসার (১৮১৫); বিভিন্ন উপনিষদের অনুবাদ ইত্যাদি।
রামমোহনের গদ্য সাহিত্য পর্যালোচনা :-
রামমোহনের রচনা শৈলী ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে করি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন দেওয়ানজী (রামমোহন) জলের ন্যায় সহজ ভাষায় লিখিতেন, তাহাতে কোনো বিচার ও বিবাদঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতিসহজ স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাটা ও প্রাদুশ মিষ্টতা ছিল না।
রামমোহন ব্রহ্মবাদী বলে একেশ্বরবাদের অর্থ তাঁর মূলমন্ত্র ছিল। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন বেকন, নিউটন, ভলতেয়ার, রুশো প্রভৃতি মনীষীদের রচনাও মনে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি তাঁর সংগৃহীত জ্ঞান অবলম্বনে বেদান্ত ও উপনিষদের অনুবাদ করেন। ১৮১৫-তে প্রকাশিত হয় 'বেদান্তগ্রন্থ'।
সমস্ত জীবন ধরে রামমোহনকে শাস্ত্র ব্যাখ্যা আর লেকচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল।
কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার', 'গুরুপাদুকা', 'অনুষ্ঠান' এসব গ্রন্থগুলি অতি সংক্ষিপ্ত। ব্রহ্মসঙ্গীত নামে একটি গ্রন্থে প্রায় ৩২টি রামমোহনের লেখা গান সংকলিত আছে। বিবেক-বৈরাগ্য, ব্রহ্মবন্দনা প্রভৃতি এদের বিষয়।
রামমোহনের বিশেষ কৃতিত্ব 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' রচনায়। বইটিতে রয়েছে ৪টি অধ্যায় উচ্চারণ শুদ্ধি, লিপি শুদ্ধি, পদবিধান, লিঙ্গ-বচন। এই বইতে তদ্ভব ও দেশী শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার আছে।
3.বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর:
ভূমিকা:
বাংলা সাহিত্যে ধারাবাহিক পদ্য রচনার সূত্রপাত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর লেখকদের মাধ্যমে। বিশৃঙ্খল গদ্য রূপ রীতি কে শৃংখলাবদ্ধ সামঞ্জস্য বিধানে ফোর্টউইলিয়াম কলেজ এর অবদান ছিল অবিস্মরনীয়। ফোর্টউইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের লেখালেখিতেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশ ঘটে এবং সঠিক সু পথে চালিত হয়।
কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য:
এদেশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর দেশ শাসনের প্রয়োজনে ইংল্যান্ড থেকে আনা হল সিভিলিয়ানদের। কিন্তু তারা এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার আচরণ এমনকি এ দেশের ভাষার সঙ্গে ছিল অপরিচিত। অথচ এসব না জানলে মানুষদের সঙ্গে কথা না বললে দেশ শাসন করা দুঃসাধ্য। তাই বিলেত থেকে আসা তরুণ সিভিলিয়ানদের এই সমস্ত বিষয় শিক্ষাদানের জন্য তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি (১৮০০) খ্রিস্টাব্দে কলকাতা লালবাজার 'কলেজ অফ ফোর্ট উইলিয়াম' প্রতিষ্ঠা করলেন।
বাংলা গদ্যসাহিত্য বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতদের অবদান:
বাংলা ভাষা শেখানোর কোন পাঠ্যপুস্তক না থাকায় উইলিয়াম কেরির তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত, ফারসি, আরবি জানা পন্ডিত মনীষীদের দিয়ে বাংলা গদ্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে প্রয়াসী হলেন। বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে সেইসব পন্ডিতরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ক) উইলিয়াম কেরী: উইলিয়াম কেরি একজন বিচক্ষণ ভাষাবিদ পন্ডিত ছিলেন। ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা ছাড়াও কেরির উল্লেখযোগ্য দুটি গদ্য রচনা কথোপকথন ও ইতিহাস মালা।
খ) রামরাম বসু: ফোর্টলিয়াম কলেজ এর অন্যতম পন্ডিত রামরাম বসু বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্বের বিশিষ্ট রচয়িতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর রচিত প্রধান দুটি গদ্য গ্রন্থ রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র ও লিপিমালা।
গ) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার:- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক মন্ডলীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। কলেজের পণ্ডিতদের মধ্যে পাণ্ডিত্য, মনীষা ও ওদার্যে মৃত্যুঞ্জয় শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্বে তিনি একজন যথার্থ শিল্পী তাঁর রচিত রচনাগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল
বত্রিশ সিংহাসন: বত্রিশ সিংহাসন এর গল্পের মূল ইতিহাস ও জনশ্রুতি। আদর্শ রাজা বিক্রমাদিত্যের চরিতকথা ও মহানুভবতা বর্ণনা এই ৩২টি গল্পের উদ্দেশ্য। রাজা বিক্রমাদিত্যের নিঃস্বার্থ পরোপকারী চরিত্র বর্ণনার জন্য গল্প রচিত হয়েছিল।
হিতোপদেশ: এই অনুবাদগ্রন্থ পশু পাখির মুখে অবিকল মানুষের ভাষা বসিয়েছেন তিনি। কোথাও কৌতুক, কোথাও উপদেশ, কোথাও নিছক বর্ণনা গ্রন্থটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। তিনি মনে করেছিলেন সাধু বাংলা গদ্যের রীতির জন্য সংস্কৃতের আদর্শ অনুসরণ করা উচিত।
রাজাবলি: হিন্দুযুগ, মুসলমান শাসক ও ইংরেজ আমলের ইতিহাস অবলম্বনে রচিত রাজাবলি। বর্ণনাভঙ্গি সহজ এবং জটিলতা বর্জিত তবে বাক্যরীতি সংস্কৃত অনুসরণে তৈরি।
প্রবোধ চন্দ্রিকা: প্রবোধ চন্দ্রিকা মৃত্যুঞ্জয়ের অন্যতম রচনা। গ্রন্থটি মূলত সংকলন গ্রন্থ। সংস্কৃত ব্যাকরণ, অলংকার, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতি থেকে মৃত্যুঞ্জয় নানা ধরনের উপাখ্যান ও রচনারীতি সংগ্রহ করেছেন। সেই সঙ্গে লৌকিক কাহিনীর সন্নিবেশে গ্রন্থটি রচিত। গ্রন্থটিতে কথ্যরীতি, সাধুরীতি, এবং সংস্কৃতানুসারী রীতি তিনটি রীতিই লক্ষ্য করা যায়।
গদ্য সাহিত্য বিকাশে পন্ডিত মনীষীদের অবদান:
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিবর্তনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
১. বাংলা গদ্যের জড়ত্ব মুক্তিতে তাদের প্রয়াস অনেকটাই সফল। বাংলা গদ্যের মান নির্ণয়ে তারা সহায়ক হয়েছিলেন।
২. ইতিহাস ও গল্প রচনায় তারা পারদর্শীতা দেখিয়ে ছিলেন।
৩. অনুবাদ সাহিত্যেও তাদের পাণ্ডিত্য লক্ষ করা যায়।
৪. পাঠ্যপুস্তক রচনায় তারা সফল
৫. গদ্য সাহিত্যের সঠিক পথ ও সঠিক দিশা তারাই প্রথম দেখেছিলেন।
বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে, বাংলা গদ্যের গঠনে ফোর্টউইলিয়াম কলেজের পন্ডিতরা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা অস্বীকার করা যাবেনা। শিল্পসম্মত আধুনিক গদ্যের তারাই যথার্থ পূর্বসূরী।
Marks:-6
1.বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান আলোচনা করো।
বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদন দত্ত এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা প্রচলিত নাট্যধারায় অভিনবত্বের আমদানি করেন। বাংলা নাট্যমঞ্চে মধুসূদনের আবির্ভাব কিছুটা আকস্মিকভাবেই। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা 'রত্নাবলী' নাটকের অভিনয় দেখে মধুসূদন বিরক্ত হয়ে নিজেকে বাংলা নাটক রচনায় নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর চেষ্টায় বাংলা নাটকে ইউরোপীয় নাট্যরীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
মধুসূদনের নতকগুলিকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা-
১. পৌরাণিক নাটক:-
মধুসূদনের প্রথম নাটক 'শর্মিষ্ঠা' (১৮৫৯) । মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতির উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত নাটক। ৫ অঙ্কে রচিত এই নাটকটি। মধুসুদনের জীবদ্দশায় এই নাটকের ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।গ্রীক নাটক 'Apple of Discord অবলম্বনে রচিত পৌরাণিক নাটক হল পদ্মাবতী (১৮৬০)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকেই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।
২. ঐতিহাসিক নাটক:-
কৃষ্ণকুমারী (১৮৬২) নাটকের বিষয়বস্তু গ্রহণ করা হয়েছে কর্নেল টডের 'রাজস্থান' (Annals and antiquities of Rajasthan) গ্রন্থ থেকে। নাটকের মূল চরিত্রগুলি হল ভীমসিংহ, জগৎসিংহ, কৃষ্ণকুমারী। মোট ৫ অঙ্ক বিশিষ্ট এই নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ও প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি।
৩. রূপক নাটক:-
মায়াকানন (১৮৭৪) মধুসূদনের লেখা শেষ নাটক । এটি একটি রূপক নাটক। এই নাটকটি পাঁচ অঙ্কে বিন্যস্ত। মূল চরিত্রগুলি হল অজয়, ধুমকেতু, রামদাস, ইন্দুমতী, শশিকলা। নাটকটি ১৮৭৪ সালের ১৮ এপ্রিল বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়।
৪. প্রহসন:-
বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) মধুসূদনের লেখা একটি প্রহসন । এই নাটকের পূর্বনাম 'ভগ্ন শিবমন্দির'। ইয়ং বেঙ্গলদের প্রতি ব্যঙ্গ করে একেই কি বলে সভ্যতা?' (১৮৬০) এই প্রহসনটি রচিত হয়।প্রহসনটির প্রথম অভিনয় হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই শোভাবাজার নাট্যশালায়। পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকোথিয়েটারেও এর অভিনয় হয়েছিল।
মূল্যায়ন :-
কেবল বাংলাকাব্য ক্ষেত্রেই নয়, নাট্যসাহিত্যেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। সমকালীন নাট্যধারার দুর্বলতাকে মনে রাখলে মধুসূদনের নাট্যকৃতির প্রশংসা করতেই হয়। মধুসূদনের পূর্বে বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীর নাটক তখনও কেউ লেখেননি।ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই লেখেন-"এই দুখানি প্রহসন থেকেই দেখা যাবে মধুসুদন নানা ধরনের বাংলা, মায়া উপভাষা-কতটা জানা ছিল, আর জনজীবনের সঙ্গে তিনি কতটা নিবিড় ভাবে পরিচিত ছিলেন।" বস্তুত মধুসুদন যদি আর একটিও নাটক না লিখতেন তবে এই প্রহসন দুটিই নাট্যকার মধুসূদনের কৃতিত্ব বিচারে যথেষ্ঠ হত। আধুনিক রীতির নাটক রচনা করে মধুসূদন পরবর্তী নাট্যকারদের নাটক রচনায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনায়, ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় এবং প্রহসন রচনায় মধুসূদন নাট্য ক্ষেত্রেও বিচিত্র প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন।
2.Q: বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আলোচনা করো।
ভূমিকা:
বাংলা নাট্য সাহিত্যে মধুসূদনের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব। মাইকেল মধুসূদনের সৃষ্টিতে যে নাটকের সার্থক প্রকাশ ঘটে দীনবন্ধু তাকে আরো পূর্ণ ও বিকশিত করে তোলেন। তিনি মাইকেল- যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তো অবশ্যই, আধুনিক কালেও তাঁর মর্যাদা ও মহিমা কমেনি। বিশেষত নীলদর্পণ' নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি যে প্রতিবাদী জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন আজও তা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। সমসাময়িক সামাজিক জীবনের উজ্জ্বল আলেখ্য হিসাবে তার নাটক গুলির স্বতন্ত্র মর্যাদা রয়েছে।
দীনবন্ধুর প্রথম নাটক নীলদর্পণ' (১৮৬০) নীলকরদের অত্যাচারের ওপর ভিত্তি করে লেখা প্রায় সত্য কাহিনীর রূপায়ণ। সে সময় নীলকররা বাংলার কৃষকদের জোর করে নীলচাষ করাত। নীলের চাষে চাষীদের কোনো লাভ হত না, তাছাড়া দাদনের টাকা বাকি বকেয়া শোধ ইত্যাদিতে তারা অত্যন্ত পীড়িত হত এবং দেনা ও ঋণসমেত চুক্তির বোঝা তাদের পুরুষানুক্রমে বহন করতে হত। নীলকরেরা তাদের স্বজাতীয় ইংরেজ শাসক এবং গ্রামের দারোগা দেওয়ান প্রমুখের সাহায্যে চাষীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাত। যখন তখন শ্যামচাদের বাড়ি পড়ত চাষীদের পিঠে, তাদের নীলকুঠীতে বন্দী করে রেখে পীড়ন করা হত, এমন কি হত্যাও করা হত, চাষীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত, তাদের বৌ- ঝিদের ওপর অত্যাচার করা হত, জালজুয়াচুরি প্রতারণা করে চাষীদের ওপর চুক্তির দায়িত্ব দেওয়া হত। সব কিছুর প্রতিবাদে কোনো চাষী আইনের দ্বারস্থ হলে নীলকর সাহেবদের সহযোগী বিচারকরা শেষটুকুও নিঃশেষ করে দিত। বাংলার চাষীরা নীলকরদের ভয়ে ভীত ও সংকুচিত হয়ে থাকত। এরই বিরুদ্ধে দীনবন্ধু মিত্র সরব হলেন, নীলকরদের অত্যাচারের বীভৎস ও নির্মম চিত্র তিনি অঙ্কন করলেন নীলদর্পণ' নাটকে, দেশের জনমত জাগ্রত হল মানুষ প্রতিবাদে মুখর হল, মাইকেল মধুসূদনের করা ইংরেজী অনুবাদ ইংল্যান্ডে পৌঁছলে সেখানকার মানুষরাও জানতে পারলেন এই বীভৎস প্রথার কথা। পরিণামে নীলচাষ প্রথা বন্ধ হয়। বাংলার চাষীরা এই মহাসংকট থেকে রক্ষা পায়।
শ্রেষ্ঠ নাটক: তার রচিত শ্রেষ্ঠ প্রহসন গুলি হল-
(ক) সধবার একাদশী (১৮৬৬) :-
সধবার একাদশীর বিষয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার উচ্চশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের পানাসক্তি, লাম্পট্য, পরস্ত্রীহরণ প্রভৃতি চরিত্রভ্রষ্টতার কাহিনি। 'সধবার একাদশী'র শ্রেষ্ঠ গুণ-এর একান্ত বাস্তব ও অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় কথাবার্তা। কথোপকথনের ভঙ্গিও আকর্ষণীয়। চরিত্র চিত্রণও স্বাভাবিক।
(খ) বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬):
বিয়ে পাগলা বুড়ো' মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রৌ' প্রহসনের অনুসরণে রচিত। এই প্রহসনে বিবাহ বাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের অকাল পরিপক্ক ছেলেরা কিভাবে নাস্তানাবুদ করেছিল তারই কৌতুককর দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে।
বিয়ে পাগলা বুড়ো' নিখুঁত হাস্যরসপ্রধান প্রহসন হিসাবে একটি অপূর্ব সৃষ্টি। এর মধ্যে ধারালো কথার তীব্র ঝালক নেই। কোন গভীর সমাজ সমস্যার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও নেই। হাস্যরসের অনর্গল ধারায় প্রহসনটি আগাগোড়া স্নিগ্ধ ও মধুর।
(গ) জামাই বারিক (১৮৭২): -
জামাই বারিক' প্রহসনটি সমাজের বাস্তব সমস্যা অবলম্বনে রচিত। পূর্বে কুলীন জামাইরা নিষ্কর্মা ও বেকার অবস্থায় শশুরবাড়িতে থাকত। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য শ্বশুরের উপর নির্ভর করতে হত বলে তারা সকলের কাছে হাস্যাস্পদ হত। এদের করুণ অবস্থা ও দুঃখের কথা দরদী নাট্যকার হাস্যরসের অনাবিল স্রোতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। সপত্নী-ঈর্ষা, কলহপীড়িত দ্বিপত্নীক স্বামীর সমস্যা প্রহসনে আলোচিত। দীনবন্ধুর প্রহসনগুলির মধ্যে হাস্যরসের প্রাবলা 'জামাই বারিকে সবচেয়ে বেশি।
(ঘ) লীলাবতী (১৮৬৭):-
দীনবন্ধুর পরিণত ভাবনার ফসল। নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতে ঘটনার দ্বন্দ্বে নাটকটি সার্থক। নাটকের বিষয় প্রেম, প্রেমের বিলাস ও বৈচিত্র্য নাটকে আছে। ব্রাহ্ম আন্দোলন ও স্ত্রীশিক্ষার প্রতি লেখকের পক্ষপাত স্পষ্ট। আগের নাটকের মতো কৌলীন্যপ্রযার অনিষ্টকর দিকটিও নাটকে দেখানো হয়েছে।দীনবন্ধুর শেষ নাটক 'কমলে কামিনী' (১৮৭৩০) যাতে ইতিহাসকে আনা হয়েছে ও ঐতিহাসিক গম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টির চেষ্টা আছে। কৌতুকরসের প্রকাশও কম নেই। তবু নাটক হিসেবে এটি উচ্চমানের।
3.কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান লেখ।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য যার উপর ভিত্তি করে বিকাশ লাভ করেছে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার মূল পরিচয় কবি হিসাবে হলেও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি অবাধে পদচারণা করেছেন। বাংলা কবিতা, বাংলা নাটক, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য, বাংলা পত্রসাহিত্য, বাংলা ভ্রমণসাহিত্য, বাংলা গান প্রভৃতিতে তিনি উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন।
কাব্য সাহিত্য
সাহিত্যিক প্রতিভা বহুমুখী হলেও বাংলা কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অবদান গৃহীত হয়েছে। কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের অন্তরের সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভূতিকে যে রূপ দিয়েছেন এবং নিজের অন্তরের সর্বোচ্চ আধান্তিক চেতনাকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন তার প্রতিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রথম যুগের কবিতা সংকলন 'মানসী' (1890) ও 'সোনার তরী' (1893) তার এই দুইখানি গ্রন্থে এই কবিতাগুলি যেমন অভিনব তেমনি অপূর্ব রস স্বাদ পূর্ণ মানুষের মনে যে সব সুখ দুখ আশা আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা ভাবনা প্রভৃতির স্রোত অনবরত প্রভাবিত হয়। তা ভাষায় প্রকাশ করতে না পারায় মানুষ একটি অব্যক্ত বেদনা অনুভব করে। তার প্রকাশ বেদনা নামক কবিতায় তিনি মানুষের চিন্তা ভাবনা গুলি তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতায় অতি উচ্চ স্তরের দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। মানবিক ভাববেগ বিস্তারের মাধ্যমে তিনি বহিপ্রকৃতিকে নতুন রূপে পরিচিতি দেওয়ার জন্য পুরানো পটে, নতুন নতুন ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটি দার্শনিক আধ্যানিক অনুভবেরও পরিচয় দিয়েছেন। 'মানসী' এবং 'সোনার তরী' এই দুটি গ্রন্থে কবি কল্পনার রাজ্য ছেড়ে সংসারের দুঃখময় বাস্তব জীবনের রূপ তুলে ধরেছেন তার ফলে কবির বাস্তববাদী মন যে নতুন আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছে তা 1896 সালে প্রকাশিত 'চিত্রা' নায়ক গ্রন্থের 'এবার ফিরাও মোরে' কবিতাটির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। এটি রবীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট জীবনে কেবল কবিতায় নয়, সমগ্র সাহিত্যিক রচনার উৎস ও প্রধান প্রেরণা বলে মনে করা যেতে পারে।
1913 সালে গীতিকাব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ জগতবিখ্যাত 'নোবেল পুরস্কার' লাভ করে বিশ্ব সাহিত্যে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদার অধিকারী করে তুলেছিলেন। কিন্তু কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগে রবীন্দ্রনাথের দান অমূল্য ও অপরিসীম। এছাড়াও গীতি কবিতার সহিত ছোট গল্পেরও কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
4.বাংলা কাব্য কবিতার ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান ও ভূমিকা লেখ ?
ভারতবর্ষ পরাধীন। পরাধীন ভারতবর্ষে তখন চলেছে উত্তাল মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রাম। গান্ধীজীর নেতৃত্বে একের পর এক বিপ্লব ঘটে চলেছে এদেশে। অসহযোগ আন্দোলন সারা বাংলা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। ঠিক সেই সময়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বিদ্রোহের বাণী নিয়ে বাংলা কাব্য জগতে আবির্ভূত হলেন নজরুল। সমসাময়িক যুগ চেতনায় তাঁর কাব্যের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের প্রতি তার বিদ্রোহ। বিদ্রোহই এ দেশের জমিদার, মালিক ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে। এদের অত্যাচারের কাছেই খুঁজে পেলেন তার কাব্যের ভাষা। তবে তার এ বিদ্রোহ মূলত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। নজরুল এসেই যে বিদ্রোহের বাণী সঞ্চারিত করে দিলেন তার তেজ ভবিষ্যতে কখনো স্তিমিত হয়ে পড়েনি। তাই রবীন্দ্রনাথের পর বর্তমান কাব্য আন্দোলনের মধ্যে সঠিকভাবে কেউ যদি কবিতার মোড় ঘুরিয়ে থাকেন তিনি হবেন নজরুল। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করেছেন: "সব কটা জানালা খুলে নূতনের হাওয়া প্রথম যিনি সবেগে বইয়ে দিলেন, তিনি নজরুল ইসলাম, নজরুলের ছিল দৃপ্ত কণ্ঠস্বর।
কাজী নজরুল ইসলামের রচিত কাব্য গ্রন্থ:
অগ্নিবীণা (১৯২২), ভাঙার গান (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), ফণিমনসা (১৯২৭), চক্রবাক্ (১৯২৯), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), সিন্ধুহিন্দোল (১৯২৭), প্রলয়শিখা (১৯৩০) ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের পটভূমি:
ঘটনাবহুল নজরুলের জীবনের মতোই তাঁর কাব্যের পটভূমিও বৈচিত্র্যময়। বিষয় বৈচিত্র্যে ও কল্পনায় নজরুলের কবিতা সমৃদ্ধ তাঁর কবিতা সমূহকে সাধারণভাবে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। ১। বিষয় নিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান। ২। ব্যক্তিনিষ্ঠ ও কল্পনা প্রধান। প্রথম পর্যায়ের কাব্য কবিতার মধ্যে সমাজ; সমাজের আর্থ রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যা, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, অভিযোগ, স্বদেশ, যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশুদ্ধ Lyric বা কবি মনের ভাব উচ্ছ্বাস, ব্যক্তিময়তা বা মৃন্ময়ভাব প্রাধান্য পায়। যদি নজরুলের সমগ্র কাব্য কবিতাকে সঠিক বিশ্লেষণের দ্বারা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিভাজন করা যায় তাহলে কয়েকটি বিভাগ বেশ প্রকট হয়ে ওঠে-
1) বিদ্রোহ ও সমাজ ভাবনা:
নজরুলের বস্তুনিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান কবিতাগুলির মধ্যে বিদ্রোহী, ফরিয়াদ, সাম্যবাদী,অন্ধস্বদেশ, দেবতা, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এইসব কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও বিদ্রোহের দীপ্তি ও দাহ যুগমানসের বৈশিষ্ট্য রূপে প্রকাশ লাভ করেছে। আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় তিনি স্পষ্টই বলেছেন:
"প্রার্থনা করো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস।
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।"
2) প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক:
বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কবিতার মধ্যেই নজরুলের কবি প্রতিভা শুধু আবর্তিত হননি। 'বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি' গানের আড়াল, আমি গাই তার গান প্রভৃতি কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির অপূর্ব সমাহার অনুভব করা যায়। যেমন বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি কবিতায় কী আশ্চর্য সুন্দর প্রেম চেতনা আত্মপ্রকাশ করেছে:
নিশীথিনী যায় দূর বনছায় তদ্রায় ঢুলুঢুলু।
3) শিশু বিষয়ক:
কাজী নজরুল বেশ কিছু শিশু বিষয়ক কাব্য কবিতা নাটক রচনা করেছেন। তার 'খুকুও কাঠবিড়ালী', 'প্রভাতী', 'লিচুচোর', 'ঝুমকো লতায় জোনাকী', 'মটকু মাইতি', 'বাঁটকুল রায়', 'ঘুমপাড়ানি গান', 'আমি যদি বাবা হতাম', 'বাবা হত খোকা', 'সাত ভাই চম্পা', 'শিশুর জাদুকর' ইত্যাদি কবিতাগুলি এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। খুকুর চোখে কাঠ বিড়ালীর যে জীবন্ত অবয়ব ফুটে উঠেছে তা সত্যই চমৎকার:
"দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট?
আমায় দেখে যাও।।"
কাঠবিড়ালী। তুমি মর?
তুমি কচু খাও।।
4) সঙ্গীত বিষয়ক:
গান রচনায় নজরুল 'স্বরাজ্যে স্বরাট'। তারই রচিত গান নজরুল গীতি নামে পরিচিত। তিনি আগমনী বিজয়া, রাম শ্যাম বা কৃষ্ণ, চৈতন্য শঙ্কর দুর্গা, সরস্বতী বন্দনামূলক, মহাপুরুষ বন্দনা, বৈষ্ণব ভাবমূলক, হাস্য রসাত্মক, গজল, মারফতী-মর্শিদ, জারি, সারি, ঝুমুর, খেয়াল ঠুংরী, বাউল, কাজরী, ভাটিয়ালী শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করে সাঙ্গীতিক প্রতিভার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
5.বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।
বাংলা কথা সাহিত্যের জগতে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি রবীন্দ্রনাথের স্বকীয়তাকে মেনে নিয়েও সাহিত্যে নতুন কথা শোনালেন। শরৎচন্দ্র জানালেন
"সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না, সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছু অধিকার নাই...."
শরৎচন্দ্র তাঁর সমকালে সামাজিক সমস্যাগুলিকে উপলব্ধি করেছিলেন খুব কাছে থেকেই। তাই জীবনের সমস্যাগুলিকে তিনি বেশি করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্বে দায়ী সমাজ। তবে একথা ঠিকই তিনি সমাজকে দায়ী করলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও সমাধানের পথ দেখাননি।
শরৎচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে 'বড়দিদি' (১৯১৩), 'পরিণীতা' (১৯১৪), 'পণ্ডিতমশাই' (১৯১৪), 'বিরাজ বৌ (১৯১৪), মেজদিদি' (১৯১৫), 'চন্দ্রনাথ' (১৯১৬), 'পল্লীসমাজ' (১৯১৬), 'অরক্ষণীয়া' (১৯১৬), 'শ্রীকান্ত' (প্রথম) (১৯১৭), 'দেবদাস' (১৯১৭), 'নিষ্কৃতি' (১৯১৭), 'চরিত্রহীন' (১৯১৭), 'দত্তা' (১৯১৮), 'শ্রীকান্ত' (দ্বিতীয়) (১৯১৮), 'বামুনের মেয়ে' (১৯২০), 'গৃহদাহ' (১৯২০), 'দেনাপাওনা' (১৯২৩), ইত্যাদি। শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস 'বড়দিদি' ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং শেষ উপন্যাস 'বিপ্রদাসে'র রচনাকাল ১৯৩৫। তবে মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় 'শুভদা' (১৯৩৮) এবং 'শেষের পরিচয়' (১৯৩৯)।
তাঁর প্রথম উপন্যাস 'বড়দিদি'তে জমিদারের অত্যাচারের কাহিনি বর্ণিত হলেও সমাজনিষিদ্ধ বিধবার প্রেম সমস্যা এবং মাধবীর স্নেহ-ভালোবাসা-ই মুখ্য স্থান গ্রহণ করেছে।শরৎচন্দ্রের 'পল্লীসমাজ' উপন্যাসের দুটি দিক-একদিকে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর সমকালীন পল্লীজীবনের সামাজিক চিত্র ও ভাবী সমাজতান্ত্রিক সমাজের পূর্বাভীষ এবং অন্যদিকে এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে রমা ও রমেশের হৃদয়ের দ্বন্দ্ব নিপুণ তুলিতে অঙ্কিত। 'চন্দ্রনাথ' উপন্যাসে রয়েছে সনাতন আদর্শের প্রতিফলন।
শরৎচন্দ্র কোনো সামাজিক নীতিবোধকে স্বীকৃতি দেননি, বরং এর বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে সমাজশক্তি ছিল প্রবল। সেজন্য সে সময়ে সমষ্টি জীবনের দাবি ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শরৎচন্দ্র মনে করেন, সমাজশক্তি বহিঃশক্তিরূপে ব্যক্তিজীবনের অগ্রগতি বা ব্যাপ্তিকে বাধা দেবে এটা তিনি মেনে নিতে চাননি। নারীর সতীত্ব ও নারীত্ব-এ দুটোকে আলাদা করে তিনি দেখতে চেয়েছেন। শরৎচন্দ্র বরাবরই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি নাস্তিক ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্য, শিব ও সুন্দরের উপাসক। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলি মূলত সমাজের উচ্চস্তরের। সে তুলনায় শরৎচন্দ্র সমাজের সাধারণ স্তরের ক্ষুদ্র স্নেহ, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ নারী চরিত্রগুলিকে এঁকেছেন তাঁর উপন্যাসে।
6.বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান লেখ।
বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন করে মেজাজ ও ভঙ্গির প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তোলার প্রয়াস যিনি একমাত্র করেছিলেন তিনি হলেন 'সবুজ পত্র'র সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী। তিনি প্রবন্ধের মধ্যে মজলিশি আলাপের সুর, খেয়াল-খেলার লীলায়িত ছন্দ, ভারমুক্ত স্বচ্ছন্দ মনন সঞ্চরণের প্রবর্তন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধে মাঝেমাঝে হালকা চাল থাকলেও প্রমথ চৌধুরীর আলোচনা গাম্ভীর্যপ্রধান ও গভীর সুরে অনুরণিত। এছাড়া তার তীক্ষ্ণযুক্তি, লঘু কল্পনা ও স্বচ্ছন্দচারী খেয়াল প্রভৃতির মাধ্যমে যে পরিমণ্ডল রচনা করেছেন তা একান্ত প্রমথ চৌধুরীর মতোই।
তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি হল 'তেল-নুন-লকরি' (১৯০৬), 'বীরবলের হালখাতা' (১৯১৭), 'নানাকথা' (১৯১৯), 'দুইয়ারকি' (১৯২০), 'আমাদের শিক্ষা' (১৯২০), 'বীরবলের টিপ্পনী' (১৯২১), 'রায়তের কথা' (১৯২৬), 'নানাচর্চা' (১৯৩২), 'প্রাচীন হিন্দুস্থান' (১৯৪০), 'আত্মকথা' (১৯৪৬)।
প্রমথ চৌধুরীর গদ্য ও প্রবন্ধশৈলীর বৈশিষ্ট্যগুলো হল -
১। সাহিত্যের ভাষাকে তিনি মুখের ভাষার অনেক কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। সাহিত্যের তথাকথিত সাধুভাষা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, 'তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোনো স্থান নেই।'
২। প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যে চলিত ভাষার পক্ষপাতী হলেও তাঁর গদ্যরীতিকে 'মৌখিক গদ্যরীতি' বলা চলে না। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'শুধু ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম ছাড়া প্রমথ চৌধুরী আর কোনো দিক দিয়ে মুখের ভাষার বিশেষ অনুকরণ করেননি, বরং অনাবশ্যক মারপ্যাঁচ, বাচনভঙ্গির অকারণ তির্যকতা, ও অলঙ্কারের চাকচিক্য তাঁর চলিত ভাষাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধু ভাষার চেয়েও দুরূহ করে তুলেছে।
৩। ভাষা এবং সাহিত্য দু'রকমের রচনাই তিনি লিখেছেন। ভাষা বিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -'বঙ্গভাষা বনাম বাবু বাংলা ওরফে, সাধুভাষা', 'কথার কথা', 'আমাদের ভাষাসঙ্কট', 'সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা', 'বাংলা ব্যাকরণ' ইত্যাদি। সাহিত্যবিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-'সাহিত্যে চাবুক', 'সাহিত্যে খেলা', 'কাব্যে অশ্লীলতা' ইত্যাদি। ভাষা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, 'ভাষামার্গে আমি ভারতচন্দ্রের পদানুসরণ করেছি। সাহিত্য কেন্দ্রিক রচনাগুলিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ সুলভ দৃষ্টি এবং পরিহাস প্রবণতা যুক্ত হয়েছে।
৪। কথকতা সুলভ ভঙ্গি, চলিত ভাষা প্রয়োগ, বাগবৈদগ্ধতা, ব্যাঙ্গ ও পরিহাস প্রবণতা তাঁর গদ্যসাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৫। প্রমথ চৌধুরীর গদ্যকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'ইস্পাতের ছুরি'। তিনি আঙ্গিকের কাঠিন্যতা থেকে প্রবন্ধ সাহিত্যকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রবন্ধে তিনি বিষয় নিয়ে খেলা করেছেন এবং খেলার আনন্দ উপভোগ করেছেন।
৬। মুখের কথাকে তিনি শিল্পকলায় রূপান্তরিত করেছেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে প্রাবন্ধিক হিসাবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব রেখে গেছেন। যদিও অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, "যথার্থ মুখের ভাষাকে সাহিত্যকর্মে ব্যবহারের গৌরব হুতোম ও বিবেকানন্দের প্রাপ্য, প্রমথ চৌধুরীর নয়।"-তবুও তাঁর ভাষারীতির স্বাতন্ত্র্য আছে, সেই স্বাতন্ত্র্য কৃত্রিম হলেও তাকে সাহিত্যে যথাযথ স্থান করে দেওয়ায়, বাবৈদগ্ধ্যপূর্ণ ভাষার ব্যবহারে, বাঙালি মনন ও সংস্কৃতি'কে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তিদান করে, প্রমথ চৌধুরী চলিত রীতির বাংলা গদ্যের যে নতুন সন্ধান দিয়েছেন এবং প্রবন্ধে আঙ্গিকের যে পরিবর্তন এনেছেন সেজন্য প্রাবন্ধিক হিসাবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
Marks:-3
1.নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান লেখ।
ভূমিকা :
দীনবন্ধু মিত্রের পরবর্তী কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১) বাংলা নাট্য জগতকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ নাট্যকার ও প্রয়োগশিল্পী। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাঙালী দর্শক সর্বপ্রথম প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিল। প্রথমে অভিনেতারূপে আত্মপ্রকাশ করে তিনি অন্যের লেখা নাটক অভিনয় করতেন, পরে নিজেই নাট্য রচনা শুরু করেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক :
গিরিশচন্দ্র ঘোষের পূর্ণাঙ্গ নাটকের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশখানা, এছাড়া প্রহসন, পঞ্চরং রূপক রঙ্গব্যঙ্গের নাটক ও অনুরূপ। এই প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্রের সমস্ত নাটকগুলিকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন –
(ক) গীতিনাট্য :
গিরিশচন্দ্র নাটক রচনায় মনোনিবেশ করে সর্বপ্রথম কয়েকটি গীতিনাট্য রচনা করেন। আগমনী , প্রাক্প্রতিমা , অকালবোধ , দোললীলা এগুলি সমস্তই অভিনয়ের দ্বারা দর্শক মাঝে আলোড়ন তুললেও এগুলি সাহিত্যরস সৃষ্টিতে ব্যাহত হওয়ায় পরবর্তীকালে এই সকল নাটকের অভিনয় আর হয়নি বললেই চলে।
(খ) পৌরাণিক নাটক :
অভিমন্যুবধ , রাবণবধ , নল-দময়ন্তী , জনা প্রভৃতি নাটকের মধ্যে পুরাণের বিষয়ে বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ আশা কামনার সঙ্গে একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই মিশে গেছে রচনার গুণে ।
গ) পৌরাণিক ভক্তিরসের নাটক :
এই শ্রেণীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল (ক) চৈতন্যলীলা (১৮৮৪) (খ) বিশ্বমঙ্গল (১৮৮৮) ইত্যাদি। কেবলমাত্র ভক্তি রসকেই আশ্রয় করেই এই পর্বের নাটকগুলি রচিত।
ঘ) ঐতিহাসিক নাটক :
বিংশ শতকের পাদলগ্নে সমগ্র ভারতবর্ষ যখন দেশীয় ইংরেজ শাসকের অত্যাচারে উত্তাল।সেই প্রেক্ষাপটে গিরিশচন্দ্র ঘোষ কয়েকটি ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে রচনা করলেন স্বদেশ প্রেমের নাটক। যেমন – সিরাজদ্দৌলা , মীরকাশিম , ছত্রপতি শিবাজী , অশোক ইত্যাদি।
(ঙ) সামাজিক নাটক :
ভক্তি, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক পর্বের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পর গিরিশচন্দ্র আত্মনিয়োগ করলেন সামাজিক নাটক রচনায় যা দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র। গিরিশ চন্দ্র বাস্তবজীবন সম্পর্কে এত তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছিলেন তার সম্যক পরিচয় মেলে এই পর্বের নাটক রচনার গুণ দেখে।প্রফুল্ল , হারানিধি , বলিদান ,মায়াবসান প্রভৃতি নাটক ।
মূল্যায়ন :
চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নায়ক-নায়িকা অন্তর্দ্বন্দ্ব, জীবন সম্পর্কে গভীর প্রত্যয় তাঁর নাটকে যে ভাবে প্রকাশ পেয়েছে , তাতে তাঁকে অনায়াসে প্রথম শ্রেণির নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । তিনি নিজের হাতে বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি করেছিলেন ।
2. সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তেভাগা আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।
১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যাঁতাকলে ১৫০ বছর ধরে জোতদার-জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণের শিকার হতে হয়েছে কৃষককে। মাঝেমাঝে কৃষকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও সর্বাত্মক সংগঠিত চেহারা নিতে পারেনি সেইসব আন্দোলন। বিগত ছয়-সাত বছর ধরে বাংলার ভূমি রাজস্ব কমিশনের ফসলের তিনভাগের দুইভাগ অংশ কৃষকের প্রাপ্য এই মর্মে সুপারিশ নিয়ে টালবাহানার শেষে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সিদ্ধান্ত ক্রমে ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে ফসল কাটার মরশুমে শুরু হয়ে যায় তেভাগার সংগ্রাম। ফসলের তিনভাগের দুইভাগ কৃষকের ও একভাগ জমিদারের এই দাবিতে আন্দোলন। তৎকালীন যুক্ত বঙ্গের ময়মনসিংহ থেকে দক্ষিণে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ১৯টি জেলায় প্রভাব পড়েছিল এই আন্দোলনের।
এই স্বাভাবিকতায় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নানা দিক ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সৃষ্টিতে। এর মধ্যে রয়েছে ছোটো গল্প, কবিতা, গান, চলচ্চিত্র, রিপোটার্জ ইত্যাদি। বিশিষ্ট মনস্বী গোপাল হালদার ওই সময়ের কালজয়ী সৃষ্টির কথাকে গণনায় রেখে একে আখ্যায়িত করেছেন 'মার্কসবাদী রেনেসাঁ' নামে। প্রথমে আসা যাক সাহিত্যের কথায়। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি অমূল্য সৃষ্টি 'হারাণের নাতজামাই' ও 'ছোটো বকুলপুরের যাত্রী'। এই দুটি গল্পকে নিয়ে চলচ্চিত্র ও নাটক সবই হয়েছে। এছাড়াও মানিক বাবু তেভাগার ওপর আরো কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, ননী ভৌমিক, সুশীল জানা, সমরেশ বসু, সৌরী ঘটক, মিহির আচার্য, মিহির সেন, আবু ইসহাক প্রমুখের রচিত অন্তত কুড়িটি গল্প বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের মাধ্যমে তেভাগা আন্দোলনের ধারাকে বহন করে চলেছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সমরেশ বসুর গল্প 'প্রতিরোধ', সৌরী ঘটকের উপন্যাস 'কমরেড', শিশিরকুমার দাসের উপন্যাস 'শৃংখলিত মৃত্তিকা', আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা', মহাশ্বেতা দেবীর 'বন্দোবস্তী 'ইত্যাদির কথা।
3.গণনাট্য বা নবনাট্য বা সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলন বলতে কী বোঝ ?
গণনাট্য, বা, গণনাট্য সংঘ হলো ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী একটি নাট্যদল যেটি ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে গণনাট্য আন্দোলন শুরু করেছিল বাংলার গ্রামীণ জনপদে সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটকের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে।
গণনাট্য মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নাট্যকর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠায় এটির মূল লক্ষ্য ছিলো তৃণমূলের গণমানুষকে নাট্যকলার মাধ্যমে সচেতন করে নিজেদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা।গণনাট্য আন্দোলন বাংলার নাট্যসাহিত্যের উপর প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এখানকার জনমানসে সাংস্কৃতিক বিকাশও সাধন করেছে।
৩০ ও '৪০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটির সাথে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের প্রায় সকল নাট্যকর্মী এবং অভিনয় শিল্পিগণ।এই সংঘের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ বিজন ভট্টাচার্য,উৎপল দত্ত প্রমুখ।
১৯১৭-১৯৭৮ সাল টা ছিল বিজন যুগ। আধুনিক গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য। নাটকের ইতিহাসে প্রচলিত ধারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তিনি। তাঁর নাটকে ফুটে উঠেছিল ঐতিহাসিক, পৌরাণিক এবং পারিবার-সামাজসহ এক ঝলক মুক্তির আলো এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ। এর আগে বাংলা নাটক উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে বৃহত্তর জনজীবনকে তেমনভাবে ছুঁতে করতে পারেন নি কেউই। বিজন ভট্টাচার্যই সর্বপ্রথম ‘নবান্ন’ (১৯৪৪)-এর মাধ্যমে বাংলার গণজীবনের সঙ্গে নাটকের সুতো বেঁধেছিলেন। তাই বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা চির অমর হয়ে আছে।
বিজন ভট্টাচার্য নাট্যজীবন শুরু করেন ১৯৪০ এর দশকে। সেই সময় বাণিজ্যিক থিয়েটারের প্রচলিত ধারার বাইরে স্বতন্ত্র নাট্য আন্দোলনের সূচনা করেন কিছু ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক, শিল্পী গোষ্ঠী। তাঁদেরই সাংস্কৃতিক শাখা ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন সেখানকার প্রথম সারির নাট্যকর্মী। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক রচনা, অভিনয় এবং নির্দেশনা এই গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেশ প্রশংসিত হয়।
4.সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নকশাল আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।
গত শতকের সত্তরের দশক ঠিক আর দশটা দশকের মতো ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। রাইফেল, রেডবুক দিকে দিকে মুক্তি আনছে— এই ছিল আহ্বান। তবে পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ি গ্রামে যা শুরু হয়েছিল, তার তুলনা মেলা ভার! ১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ি জেলায় কৃষকরা সংগঠিত হয়ে ভূস্বামী আর তাদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বারুদ যেন দিয়াশলাইয়ের আগুন পেল, দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে এ কমিউনিস্ট আন্দোলন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের এমন চেহারা এ উপমহাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি।
শুরুর দিন থেকেই নকশালবাড়ির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগোলো বাংলা কবিতা। কবিরা একদিকে যেমন শব্দে আগুন জ্বালিয়েছেন, তেমনি মাঠের লড়াইয়েও শামিল হয়েছিলেন। কবিরা খুন হয়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন, নির্যাতন সয়েছেন। নকশাল আন্দোলনের কবিতায় স্থান পেয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক আহ্বান, মতবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম, কৃষক সংগ্রামের গাথা। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে দুর্গা মজুমদার সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্র তুলে ধরেছেন তার ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ কবিতায়। কবিতা যেন লড়াইয়ে নামার সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক! সারা জীবন ধূম উদ্গীরণের চেয়ে অন্তত একবারের জন্য হলেও জ্বলে ওঠবার আহ্বান।
“নতজানু হয়ে তিলে তিলে ক্ষয়ে বাঁচবার নাম
আমি রাখলাম
মরণের স্তব—
খুনের বদলে খুন না ঝরিয়ে মরবার নাম
আমি রাখলাম
শ্মশানের শব!
মারার তাগিদে আড়ালে গা-ঢেকে বাঁচবার নাম
আমি রাখলাম
সংগ্রামী গৌরব—
মরণের মুখে থুথু ছুড়ে দিয়ে মরবার নাম
আমি রাখলাম
সশস্ত্র বিপ্লব!!
এর পর কয়েক বছর নকশাল আন্দোলন ধনী, ভূস্বামীদের, পুলিশের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল। সাধারণ ঘরের তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে পড়লেন পার্টির সশস্ত্র আন্দোলনে। নকশাল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাধারণ মানুষের বিপ্লবী রূপান্তর। মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা যে বিপ্লবের জননী, সে গল্প এবার সত্য হয়ে দেখা দিল। দান-খয়রাত নয়, রাষ্ট্রে নিজের অধিকার নিয়ে মানুষের বাঁচতে চাওয়ার দাবি উঠেছিল। আর এ চেতনা মূর্ত হলো ১৯৭৪ সালে স্বপন চক্রবর্তীর লেখা ‘আমাদের গল্প’ কবিতায়—
“আমরা সাহায্য চাইনি
কারণ আমরা বদল চেয়েছি।
চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।
নকশাল আন্দোলনে যুক্ত চারজন তরুণ কবি খুন হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে, জেলখানায় বন্দি অবস্থায়। এদের মধ্যে আছেন কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ, তিমিরবরণ সিংহ, অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও মুরারি মুখোপাধ্যায়। তিমিরবরণ সিংহ ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নকশাল আন্দোলনে গ্রামে গিয়েছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করতে। ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেলে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। অমিয় চট্টোপাধ্যায় বেহালা পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছিলেন। নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে পার্টির কাজ শুরু করেন। গ্রামে কাজ করতেন ‘সাগর’ ছদ্মনামে। গ্রেফতার হয়ে ঠিকানা হয় জেলখানা এবং জেলের অভ্যন্তরেই তাকে হত্যা করা হয়।
5.সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।
তৎকালীন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বাঙালি ছিল সর্বাগ্রগণ্য। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বও ছিল বাঙালির হাতে। এক কথায়, বাঙালি তখন সমগ্র ভারতকে পথ দেখাত। বাঙালির এই প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবে ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন আতঙ্কিত হন। তাঁর মতে, বাংলা ছিল 'অশান্তির উৎস'। রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন বাঙালিকে দুর্বল করে সমগ্র ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাঁর আমলে বাংলাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব কার্যকারী করা হয়। এই সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সমগ্র বাংলা তথা ভারতে যে আন্দোলনের উদ্ভব হয়, তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলন নামে খ্যাত ।১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বা ৩০শে আশ্বিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকারী হয়। সেদিন সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর নেতৃত্বে সেইদিন এক বিরাট মিছিল গঙ্গা স্নানে যায় এবং স্নানের পর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একে অন্যের হাতে রাখি পরিয়ে দেয়।
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের গুরুত্ব কেবলমাত্র জাতীয় ঐক্য আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাস্তবে স্বদেশী আন্দোলন বাংলা সংগীত, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিত্র শিল্প সকল দিকে প্রভাব ফেলেছিল। সুমিত সরকারের মত্রে 'No other phase of our national movement can boast of Cultural accompaniment as rich as Swadeshi' |
বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সকল সংবাদ পত্র ও সমসাময়িক পত্র প্রকাশিত হয়েছিল তা বাংলার সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। এই সময় অসংখ্য কবিতা ও গানের মাধ্যমে দেশ প্রেমের বাণী চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের 'বাংলার মাটি বাংলার জল'-ই হোক বা 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' বাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি মুকুন্দ দাসের লেখনীও উল্লেখযোগ্য। কবি ইসমাইল হোসেনের অনল প্রবাহে কাব্যগ্রন্থে হিন্দু ও মুসলিম উভয় জাতিকেই ভারতমাতার সন্তান হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। গ্রাম বাংলার পল্লীগীতি ও বাউল গানের মধ্যেও স্বদেশী বা তার আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল।
এই সময় বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে আত্মশক্তি, ভারতবর্ষ, স্বদেশ সমাজ, শিক্ষা, সমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম চৌধুরির ভারত পত্রিকায় বয়কট ও স্বাদেশীকতা ইত্যাদি নামে কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। অপর লেখকদের মধ্যে দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সখারাম গণেশ দেউস্কর, দেবী প্রসন্ন রায়চৌধুরী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসাবে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ স্থাপিত হয়। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম বাৎসরিক অনুষ্ঠান বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। নিখিলনাথ রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি ঐতিহাসিক আমাদের ইতিহাসের জ্ঞানকে সম্প্রসারিত করেছিলেন।
No comments:
Post a Comment