3) ঠান্ডা লড়াই কাকে বলে ? এর পটভূমি লেখো ? এর বৈশিষ্ঠ্য ও তৃতীয় বিশ্বে ঠাণ্ডা লড়াই এর প্রভাব আলোচনা করো ।
উত্তর:-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে একদিকে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অপরদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য গড়ে তোলার জন্য এই দুই রাষ্ট্রজোটের মধ্যে যে লড়াই শুরু হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত ।
■ ঠান্ডা লড়াইয়ের পটভূমি:-
a) চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা : ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার মিসৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনে ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরোপীয় সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন ।
b) কেন্নানের বেষ্ঠনী নীতি :- রাশিয়ায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জজ এফ . কেরান সোভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বেষ্টনী তত্ত্ব ' ( Da89.8 জুলাই ) প্রকাশ করেন , যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয় ।
c) ট্রুম্যান নীতি :- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতায় ( ১৯৪৭ খ্রি . ১২ মার্চ ) তুরস্ক ও গ্রিস - সহ বিশ্বের যে - কোনো দেশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন , যা ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত । ঐতিহাসিক আইজ্যাক ভয়েসচার ঈমান নীতিকে ঠাণ্ডা লড়ায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বলে অভিহিত করেছেন ।
d ) আমেরিকার শক্তিজোট গঠন : - সোভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলে ' উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা ' ( NATO ) | তারপর একে একে গড়ে তোলে ' দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ' ( SEATO ) ; ' মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা ( MEDO ) যা পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা ' ( CENTO ) নামে পরিচিত হয়।
e) রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিজোট গঠন : আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে- ওঠা পশ্চিমি সামরিক শক্তিজোট ন্যাটোর জবাবে রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা ( Warsaw Pact Organisation , WPO ) , যা ছিল একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ।
■ ঠান্ডা লড়াইয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-
1 ] কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে Super Power রাষ্ট্ররূপে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের । তাই ঠান্ডা লড়াই বলতে বোঝায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সারা বিশ্বে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ।
2 ) সমর্থন লাভের দ্বন্দ্ব :- উভয় রাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ও তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করতে তৎপর ছিল ।
3 ) মতাদর্শের সংঘাত :- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও সাম্যবাদের পক্ষে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় । এর পরিণতি হিসেবে ঠান্ডা লড়াই নামে রাজনৈতিক মতবাদের লড়াই শুরু হয় ।
4 ) সামরিক শক্তির দ্বন্দ্ব :- কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কেন্দ্র করে দুই শক্তিজোট ভিতরে ভিতরে জোর সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে । প্রবল থেকে প্রবলতর শক্তিসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরি ও সেগুলির পরীক্ষার নামে যুদ্ধ মহড়া শুরু হয় দুই শিবিরে । এইভাবে উভয়পক্ষই প্রবল সামরিক বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে । বিশ্বে আতঙ্কজনক বাতাবরণ গড়ে ওঠে , যা ঠান্ডা লড়াই নামে অভিহিত হয় ।
5 ) ছায়া যুদ্ধ : আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কোনো পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নেয়নি । কেবল যুদ্ধের আবহ বজায় রেখেছিল ।
■ তৃতীয় বিশ্বে ঠাণ্ডা পড়াইয়ের প্রভাব :-
[ 1 ] ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে ছড়িয়ে পড়া : দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলেই ঠান্ডা লড়াই পরিবেশের উৎপত্তি । কিন্তু ওই দুই শক্তি কখনোই নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি । অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবত থেকে দূরে সরে থাকা কিন্তু সম্ভব হয়নি |
[ 2 ] আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে জাপান , ফ্রান্সও ব্রিটেনের আধিপতা বিলুপ্ত হয়েছিল । এর ফলে এশিয়া মহাদেশের এক বিশাল অংশে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল , তা পূরণের লক্ষ্যে এগিয়েছিল ধনতান্ত্রিক আমেরিকা বা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া উভয় দেশই | ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের যে সূত্রপাত ইউরোপে হয়েছিল , তা ওই দুই মহাশক্তির হস্তক্ষেপে এবার এশিয়া মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ল । তৃতীয় বিশ্বও তা থেকে রক্ষা পেল না ।
No comments:
Post a Comment