5. ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলনে হো - চি - মিনের ভূমিকার মূল্যায়ন করো ।
Ans দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দেশ ইন্দোচিনে উনিশ শতকে যে ফরাসি প্রাধান্যের সূচনা হয়েছিল , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল । 1940 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপান দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার নীতি গ্রহণ করে এবং সমগ্র ইন্দোচিনে সাময়িকভাবে জাপানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সময় শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে ইন্দোচিনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয় এই সংগ্রামের নেতা ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা নগুয়েন আই কুয়োক , যিনি হো - চি - মিন নামে পরিচিত ।
● ভিয়েতনাম :- আন্নাম , টংকিং ও কোচিন নিয়ে গঠিত ছিল ভিয়েতনাম । 1930 খ্রিস্টাব্দে হো - চি - মিন ভিয়েতনাম ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করেন এবং পরবর্তীকালে এটি ' ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি ' নামে পরিচিত হয় । 1941 খ্রিস্টাব্দে তিনি ' লিগ ফর দি ইনডিপেন্ডেন্স ইন ভিয়েতনাম ' বা ' ভিয়েতমিন ' গঠন করেন । এছাড়াও তিনি একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলেন । এই সংগঠনের সদস্যরা গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী ছিল ।
●হো - চি - মিনের নেতৃত্ব :- ইন্দোচিনে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটার পরে জাপানের আবির্ভাবের সুযোগে আন্নাম , কম্বোজ ও লাওসের রাজারা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন । ভিয়েতমিন নেতা হো - চি - মিন এই সুযোগে টংকিং - এর সাতটি প্রদেশে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং হ্যানয় নামক স্থানটিও নিজ অধিকার করেন । হো - চি - মিনের নেতৃত্বে এইসব স্থানে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ।
● দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি:- 1945 খ্রিস্টাব্দে জাপানের আত্মসমর্পণের পর 1945 খ্রিস্টাব্দে পটসডাম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে জাপানের অপসারণের পর ইন্দোচিনের 17 অক্ষরেখার উত্তর কুয়োমিনটাং এবং 17 ° অক্ষরেখার দক্ষিণে ব্রিটেন দায়িত্ব গ্রহণ করবে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্দোচিনে ফ্রান্সের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে কুয়োমিনটাং চিন ও উত্তর ইন্দোচিনে হো - চি - মিনের ক্ষমতা দখল করে ।
●যুদ্ধের সূচনা :- ফ্রান্স কেবলমাত্র দক্ষিণ ইন্দোচিন নিয়ে খুশি ছিল না । তার লক্ষ্য ছিল সমগ্র ইন্দোচিনে ফরাসি আধিপত্যের পুন:প্রতিষ্ঠা করা । অপরদিকে হো - চি - মিনের লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনামের স্বাধীনতা অর্জন করা । 1946 খ্রিস্টাকে উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও ইন্দোচিনে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয় , যা দীর্ঘ আট বছর ধরে চলে । দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে ফ্রান্স ইন্দোচিনের কিছু শহরে নিজ আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হলেও গ্রামাঞ্চলে ছিল ভিয়েতমিন বাহিনীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।
● মার্কিন ভূমিকাঃ- পশ্চিমি শক্তিজোটের পক্ষে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল একটি অসমযুদ্ধ । মুষ্টিমের প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত , বণিক সম্প্রদায় ও আমলাগোষ্ঠীই তাদের পক্ষে ছিল । অন্যদিকে ইন্দোচিনের সাধারণ মানুষ ছিল হো - চি - মিনের পক্ষে । শুরুতে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি দেয়নি , ফ্রান্সকে মদত দিয়েছে । কিন্তু হো - চি - মিনের আন্দোলনে সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করায় আমেরিকা হস্তক্ষেপ করার নীতি গ্রহণ করে । ফরাসি সেনাপতি নেভারে ভিয়েতমিনদের ধ্বংস করতে দিয়েন বিয়েন - ফু নামে একটি অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলে । কিন্তু ভিয়েতমিন সেনাপতি জেনারেল গিয়াপ এক সময়োচিত আক্রমণে ফরাসি বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিন্নভিন্ন করে দেয় ।
●ভিয়েতকং :- 1954 খ্রিস্টাব্দের জেনেভা চুক্তির দ্বারা ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধান হয়নি । 17 ° উত্তর অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে দ্বিধাবিভক্ত করে উত্তর ভিয়েতনামে ভিয়েতমিন এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে ন দিন দিয়েম - এর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । উত্তর ভিয়েতনামে হো - চি - মিনের নেতৃত্বে সুসংবদ্ধ সরকার তৈরি হলেও দক্ষিণ ভিয়েতনামের পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে । দিয়েমের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠিত হয় । দিয়েম এই ফ্রন্টকে ভিয়েতকং বা ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট পার্টি ' আখ্যা দেন । অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে উত্তর ভিয়েতনাম তাদের নানাভাবে সাহায্য করে । এইভাবে ভিয়েতনাম ক্রমশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে থাকে ।
2. কিউবা হ্মেপনাস্ত্র সংকট কী ? এর গুরুত্ব আলোচনা করো ?
উ :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ক্যরিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত সর্ববৃহৎ দ্বীপ কিউবায় হ্মেপনাস্ত্র ঘাটি নির্মানকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সংষাত শুরু হয় তা কিউবা হ্মেপনাস্ত্র সংকট নামে পরিচিত।
● পটভূমি :- আর্থিক দিক থেকে বিচার করলে কিউবা হল একটি মার্কিন উপনিবেশ। কিউবার অর্থনীতি পুরোপুরি আমেরিকার আর্থিক সাহায্য ও বিনিযোগের উপর নির্ভরশীল ছিল। 1959 খ্রি: কিউবায় বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটলে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে কিউবার অর্থনৈতিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে কিউবা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং কিউবা ক্রমে সোভিয়েত অনুগত রাষ্ট্রে পরিনত হয়।
● ফিদেল কাস্ত্রোর ভূমিকা:- বাতিস্তা সরকারের জনবিরোধী কাজকর্মের প্রতিবাদে কিউবার তৎকালীন ছাত্রনেতা ফিদেল কাস্ত্রো তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন । ক্রমশ জনসমর্থন আদায় করে এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের দ্বারা বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে কাস্ত্রো কিউবার ক্ষমতা দখল করেন। কিউবার রাষ্ট্রপতি কাস্ত্রো এরপর পুঁজিবাদী আমেরিকার দিক থেকে সরে এসে রাশিয়া , চিন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ।
● কাস্ত্রো সরকারের অপসারণে আমেরিকার ভূমিকা : গ্রামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রোর এরকম কার্যকলাপে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নানাভাবে কাস্ত্রো সরকারের পতনের পরিকল্পনা নেয় ।1961 খ্রি: 16 ই এপ্রিল মার্কিন উদ্যোগে 1800 কাস্ত্রো বিরোধী সৈন্য কিউবায় অবতরন করেন। কিন্তু মাত্র দুদিনেই কিউবার সেনাবাহিনী এই আক্রমন প্রতিহত করতে সহ্মম হয়।
● কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গঠন :-কাস্ত্রো সরকার 50 লক্ষ কিউবাবাসীকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার সাহায্যে কিউবাতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।1982 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় একটি মাঝারি ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র ও 30 টি কেন্ট আণবিক বোমার বিমান সরবরাহ করে । বিদেশের মাটিতে এটিই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ।
●আমেরিকার প্রতিক্রিয়া:- 1962 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আমেরিকা তার গুপ্তচর বিমানের তোলা ছবি থেকে জানতে পারে যে , কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করেছে। কাজেই এখান থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র - সহ সমস্ত পশ্চিম গোলাধের নিরাপত্তাই ব্যাহত করতে পারে এই আশঙ্কায় আমেরিকা ভীত হয়ে পড়ে।
● কিউবা অবরোধ :- মার্কিন রাষ্ট্রপতি কোনেডি কিউবায় নৌ - অবরোধের নির্দেশ দেন । 1962 খ্রি: 22 অক্টোবর এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে সেই অবরোধ সম্পর্কে জানান । প্রতিক্রিয়া স্বরুপ সোভিয়েত সরকারও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে । এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় এই সমস্যার সমাপ্তি ঘটে।
গুরুত্ব:- কিউবা সংকট হ্মনস্থায়ী হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম । যেমন ---
মানবতাবাদের জয়:- কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে আণবিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল । তবে সঠিক সময় মার্কিন রাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া এর ভয়াবহতা বুঝতে পারে । এই দুই দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধের উদ্যোগ হ্রাস পেলে মানবতাবাদের জয় হয়।
No comments:
Post a Comment