5. 1909 খ্রিস্টাব্দের মর্লে- মিন্টো সংস্কার আইনের সমালোচনামূলক আলোচনা করো ।
ভারত সচিব জন মর্লে এবং বড়োলাট মিন্টো কংগ্রেসের নরমপন্থী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে এবং নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী করতে চেষ্টা করেন। পাশাপাশি কংগ্রেসবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লিগকে খুশি করার জন্য 1908 খ্রিস্টাব্দের 1 অক্টোবর ভারতের শাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি খসড়া আইন পেশ করেন । 1909 খ্রিস্টাব্দে এটি আইনের রূপ পায় , যা কাউন্সিল আইন বা মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন ( 1909 ) নামে পরিচিত হয় ।
■ আইনের বিভিন্ন দিক : মলে - মিন্টো সংস্কার আইনের দুটি প্রধান দিক– কার্যনির্বাহক পরিষদ ও আইন পরিষদ ।
● কার্যনির্বাহক পরিষদঃ- কেন্দ্র ও বিভিন্ন প্রদেশে কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়—
i) বড়োলাটের কার্যনির্বাহক পরিষদে এই প্রথম একজন ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত হয় এবং প্রথম ভারতীয় সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ ।
ii)বোম্বাই ও মাদ্রাজের কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে 2 থেকে 4 করা হয় ।
iii) বাংলার ছোটোলাটের জন্য তৈরি হয় একটি কার্যনির্বাহক পরিষদ ।
● আইন পরিষদ : মর্লে - মিন্টো আইন দ্বারা কেন্দ্র ও প্রদেশে আইন পরিষদ গঠন ও ক্ষমতা বিষয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয় ।
i) কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে 16 থেকে 60 করা হয় ।
ii ) প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে 50 জনের মধ্যে রাখা হয় ।
iii) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলি বাজেট তৈরি , বাজেট পাস , বাজেট সম্পর্কে আলোচনা ও ভোটদানের অধিকার পায় ।
iv ) আইন পরিষদ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায় ।
v) মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেয় ।
vi ) গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরগণ তাদের অপছন্দের যে - কোনো সদস্যকে আইনসভা থেকে অপসারণের অধিকায় পায় ।
● আইনের ত্রুটি:-
a) এই শাসনসংস্কার আইন দ্বারা কেন্দ্র কিংবা প্রদেশে কোনো দায়িত্বশীল শাসনব্যকথা গড়ে ওঠেনি ।
b) এই আইনের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোনো ক্ষমতা বা মতামতের গুরুত্ব ছিল না ।
c ) দেশীয় রাজ্য , সামরিক বিভাগ , বৈদেশিক নীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোনো প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভার ছিল না ।
d ) এই আইনানুসারে গভর্নর জেনারেলই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী । আইনসভার যে - কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ , বাতিল করার অধিকারী ছিলেন তিনি ।
e ) এই আইনে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের কথা বলা হয়েছিল , যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদে আঘাত হানে ।
f ) এই আইনের দ্বারা কংগ্রেসের চরমপন্থী গোষ্ঠীকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয় , অন্যদিকে নরমপন্থীদেরও আশা - আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হয়নি ।
● গুরুত্ব:- এই আইন ভারতের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল । এই আইনের দ্বারাই প্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় । এই আইনের দ্বারা বড়োলাটের শাসন পরিষদে একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করে সরকারি প্রশাসনে ভারতীয়দের যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয় । এই সংস্কার আইন ভারতে সাংবিধানিক রীতিনীতি প্রচলন ও আইনের শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে ।
6. Ans নৌবিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব লেখো ।
ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অভ্যুত্থান ছিল রয়্যাল ইন্ডিয় নেভির ধর্মঘট যা নৌবিদ্রোহ নামে ভারত ইতিহাসে খ্যাত । সুমিত সরকার লিখেছেন " ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড়ো ত্রাস অবশ্যই ছিল 1946 খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ ।
● নৌবিদ্রোহের কারণ :- 1946 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের ভারতীয় নৌবাহিনীতে ব্যাপকভাবে বিদ্রোহ ঘটেছিল তার পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল । যথা—
A) খাদ্যগত বৈষম্য : ভারতীয় নাবিকদের নিকৃষ্টমানের খাদ্য সরবরাহ করা হত । কিন্তু ইংরেজ সেনারা উচ্চমানের খাদ্য পেত । ফলে ভারতীয় নৌসেনা , কর্মী এবং অফিসারদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাধে।
B) জাভিগত বিদ্বেষ:- ইংরেজ নাবিক ও নৌ - অফিসাররা ভারতীয় নাবিক ও নৌ - অফিসারদের যথেষ্ঠ ঘৃনার চোখে দেখত । এ ছাড়া ভারতীয় নাবিকদের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহারও করা হত । ফলে ভারত নাবিক ও সেনারা ইংরেজদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে ।
C) ব্রিটিশ অফিসারদের খারাপ ব্যবহার : নৌসেনাবাহিনীতে জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ইংরেজ নৌঅফিসাররা ভারতীয় নৌসেনাদের অকারণে গালিগালাজ , অপমান ও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত । এই বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতীয় নৌসেনাদের মনে অসন্তোষের জন্ম দেয়।
D ) বেতন বৈষম্য : সমযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌসেনাদের কখনোই ব্রিটিশ নৌসেনাদের সমপরিমাণ বেতন দেওয়া হতো না । ব্রিটিশ সরকারের এই বেতন বৈষম্য ভারতীয় নৌসেনাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল ।
E ) পদোন্নতি না করানো : নৌবাহিনীতে ভারতীয় নৌসেনাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ ছিল না । এমনকী চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না ।
F ) আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার : ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ভারতীয় নৌসেনাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল । এবং তাদের বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে । আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মত্যাগ এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য এই বাহিনীর সংগ্রাম নৌসেনাদের নতুন দিশা দেখায় ।
বিদ্রোহের প্রসার : ভারতীয় নৌবাহিনীর মধ্যে উপারার কারণে বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি হয়েছিল । 1946 খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ে তলোয়ার জাহাজে ভারতীয় নৌসেনাগণ বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটায় । কিছুদিনের মধ্যেই এই বিদ্রোহ কলকাতা , করাচি , কোচিন , মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে । ভারতীয় নৌসেনিওরা বিদ্রোহটি পরিচালিত করার জন্য ' কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি ' গড়ে তোলে ।
গুরুত্ব :- নৌবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল ঠিকই , তার এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ।
এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে শুধু সাধারণ মানুষ নয় ভারতীয় নৌসেনারাও তাদের চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছে ।
এই বিদ্রোহের ফলে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় । এই বিদ্রোহে হিন্দু - মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হয়েছিল ।
এই বিদ্রোহের ফলে ভারতীয় নৌসেনা ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যবধান হ্রাস পায় এবং তারা একত্রে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে যোগদান করে ।
জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয় শীর্ষগানীয় রাজনৈতিক দলই এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল । কেবলমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের থেকেই বিদ্রোহীরা সমর্থন পেয়েছিল । শীর্ষস্থানীয় দলগুলি জাতীয় আন্দোলনের প্রসারের তুলনায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রেই অধিক মনোযোগী ছিল ।
No comments:
Post a Comment