Evolution of Kushan music in North Bengal
উত্তরবঙ্গে কুষান গানের বিবর্তন
লোকগান, নৃত্য, নাট্য মানুষের মনের গভীরকে ছুঁয়ে যাওয়ার অনেকগুলি কারণ আছে। সরাসরি জীবন থেকে উঠে আসা রসদে পুষ্ট সংস্কৃতি। তাতে থাকে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। প্রাণ থেকে উঠে আসা সুর, প্রাত্যহিক কথার বুনন আর জীবন দর্শন। ক্লান্ত সময়ের শেষে সুজনের আনন্দ, তা থেকে মনের তরতাজা হয়ে ওঠার পথ ও পদ্ধতি জীবনচর্যার বিস্তারকে আরও প্রসারিত করে। সারারাত নাট্য বা সঙ্গীতের অনুষ্ঠানের আসর তাই ভরা থাকে সহস্রে দর্শক শ্রোতায়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ'ল অধিকাংশ লোক সঙ্গীত ও নাট্য আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাই তার সঙ্গে জীবন চর্যার সম্পর্ক খুব নিবিড়। অবসর বিনোদনের জন্য যা কিছু গড়ে উঠেছে তাও জীবনের প্রয়োজনেই।
কোচবিহারের লোকনাটা কুশান। তার প্রচলন শুধু যে কোচবিহারে তা তো নয়। কোচবিহার সংলগ্ন প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও অসমে কুশান পালার জনপ্রিয়তা বেশ। কুশান পালায় কেবল রামায়ণের কাহিনিই পরিবেশিত হয় না। কুশানের অনেক পালাকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, পুরাণের কাহিনিকে উপজীব্য ক'রে নাট্য রচনা করেছেন। সেগুলি প্রবল জনপ্রিয়ও হয়েছে।
কুশান গান বেশ কিছু বছর হ'ল যাত্রার রূপ নিয়েছে। তাই এই পালাকে এখন আর কুশান গান বলা হয় না। 'কুশান যাত্রা' নামে তার পরিচয়। অতীতে সাধারণ পোশাকেই চরিত্ররা অভিনয় করতেন। পুরুষ চরিত্রগুলি ধুতি-পাঞ্জাবী এবং মহিলা চরিত্রগুলি শাড়ি-ব্লাউজ পরতেন। এখন চরিত্রানুযায়ী জমকালো পোশাক ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্যনীয় ভাবে বেড়েছে। সমবেত আবহ (Orchestra) ও 'দুকড়ি' নাচের মাধ্যমে আসরের শুরু হয়। এই নৃত্যানুষ্ঠানে ছেলেরা মেয়ে সেজে যেমন আসরে অবতীর্ণ হন তেমনই কম বয়সী মেয়েরা (তেরো থেকে সতেরো আঠারো বছরের) এই নৃত্য পরিবেশন করেন। এই নাচে যৌন আবেদন ব্যবহার করা হয় দর্শকদের আকৃষ্ট করবার জন্য। তবে মূল গীদাল এখনও সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবী পরেন। তাঁর গায়ে থাকে নামাবলী অথবা হলদে বা কমলা রঙের কাপড়। হাতে থাকে
ব্যানা।
দোয়ারীর চরিত্রটি সাজানো হয় কৌতুকোজ্জ্বল ক'রে। ভুঁড়িওয়ালা পেটের নাভির নীচে সাদা অথবা রঙিন ধুতি, আদুর শরীর রঙ দ্বারা
চিত্রিত করা হয়। মুখমন্ডলে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন রঙ, মাখায় টিকি, হাতে একটি বাঁকা লাঠি। তাঁকে দেখলেই যেন হাসির উদ্রেক হয় -তা লক্ষ্য রাখা যায়। অন্যান্য চরিত্রগুলির জন্য রূপানুযায়ী বিভিন্ন পোশাক ব্যবহার করা হয়। সব মিলিয়ে দর্শকদের আকর্ষণ করবার জন্য সাধ্যানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
কুশান পালায় অন্যতম আকর্ষণের বিষয় 'ফাঁস গান'। অনেকে 'খোসা গান'-ও বলে থাকেন। দুটি দৃশ্যের বিবতিতে গানের সঙ্গে নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এই গানের সঙ্গে মূল পালার কোনও সম্পর্ক থাকে না। গানের কথা ও নাচে যৌন ইঙ্গিত থাকে। অনেক সময়ই বাংলা, হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গান ব্যবহার করা হয়। চলচ্চিত্রের 'আইটেম সপ্ত ও ডান্স'এর মত। তবে কুশান পালায় এর প্রচলন প্রাচীন কাল থেকেই। একে 'ভর্তুকি গান'ও বলা হয়।
অতীতে কুশান পালার দল বাঁধতেন মূল গীদাল। তিনিই শিখিয়ে পড়িয়ে দলের অন্যান্যদের পালার উপযুক্ত ক'রে নিতেন। এখন মালিক দল তৈরি করেন ব্যবসায়িক স্বার্থে। তাই অভিজ্ঞ গুণী শিল্পীদের বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রিত করেন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। সেখানে শিক্ষানবীশদের কোনও স্থান হয় না। কুশান পালা প্রধান বিষয় থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। রামায়ণ, পুরাণ, ঐতিহাসিক কাহিনি নির্ভর যে পালা তা ক্রমশ নষ্ট হ'তে শুরু হয়েছে অনেক বছর হ'ল। কুশান শিল্পীরা দুঃখ করেন এ নিয়ে। তাঁরা তাঁদের যন্ত্রণার কথা বলেন। বায়নার সময় আয়োজকেরা বায়নার সময় জানতে চান দলে কতজন মেয়ে আছে, তারা দেখতে কেমন, হিন্দি সিনেমার গানের সঙ্গে নাচ
হবে কিনা ইত্যাদি। অর্থাৎ ফাঁস গানই মূল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও একটি কৌতূহলের বিষয় 'জুয়ার গান'। সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গেই আজ জুয়ার গানের ব্যাপক প্রসার। কোনও ক্লাব বা কয়েকজন ব্যক্তি দল বেঁধে আসরের আয়োজন করেন। যেখানে পালার আসর তা থেকে কিছুটা দূরে মানুষের চোখের একটু আড়ালে আর এক অঙ্গনে বসে জুয়ার আসর। সেখানে মেলে মদও, বলাই বাহুল্য। জুয়ার আসরের একজন মালিক থাকেন। জুয়ার আসর বসানোর জন্য এই মালিক আয়োজকদের অর্থ প্রদান করেন। পালার একটি আসর আয়োজনের জন্য এখন প্রায় পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। এই টাকার সিংহ পরিমান জুয়ার আসরের মালিক দিয়ে দেন। তার পরিবর্তে নির্বিঘ্নে জুয়ার আসর বসবার ব্যবস্থা ক'রে দেয়া আয়োজকেরা। কুশান বা উত্তরবঙ্গের অন্যান্য গালাগুলির জনপ্রিয়তার জন্যই এক একটি আসরে অনেক মানুষের সমাগম হয়। তাই জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করবার লোকেনা সংখ্যাও অনেক হয়। জুয়ার মালিক এই আসর থেকে লাভও করেন। কারণ তাঁর এটাই ব্যবসা। জুয়ার আসরের টাকায় যেহেতু পালার আয়োজন তাই 'জুয়ার গান' বলা হয়ে থাকে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত জুয়া ও মদের আসরের এত বাড়-বাড়ন্ত ছিল না। গত বারো-তেরো বছরে এর প্রসার ব্যাপক ভাবে হয়েছে। পালাকেন্দ্রিক জুয়ার আসরে হৈ-চৈ মারামারির ঘটনা কদাচিৎ ঘটতো। এখন তো প্রায় নিয়মিত হয়ে পড়েছে।
কুশান গানের মহান শিল্পী প্রয়াত ললিতমোহন বর্মণ। ললিত কুশানী নামেই তাঁর পরিচিতি। কুশান পালায় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তাকে বৃহত্তর সমাজের কাছে জনপ্রিয় ক'রে তোলার কাজে তাঁর অবদান অপরিসীম। ললিত কুশানীর বাড়ি দিনহাটা মহকুমার ফুলবাড়ি গ্রামে। এইই তাঁর জন্মভিটা। এই ভিটেতে তিনি জন্ম গ্রহন করেন ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ১৩ই ভাদ্র। পিতা দুর্গামোহন বর্মণ ও মাতা ভয়লক্ষ্মী বর্মণের পুত্র ললিতমোহন ফুলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত লেখাপড়া করেছেন। পিতা ছিলেন কুশান শিল্পী। সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে অ্যাঁ ললিতের সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা ছেলেবেলা থেকেই। গলায় সুর নিয়েই জন্মেছেন। তাই প্রথম থেকেই ভালো গাইতেন। তাঁর ছোটবেলায় সুরেন বসুনিয়া, কেশব বর্মণ, নায়েব আলি টেপু, আববাসউদ্দিনের রেকর্ড খুব জনপ্রিয়। ললিত সেসব গান শুনতেন আর নিখুঁত গাইতেন। সুর-তাল-লয় সহযোগে যেকোনও গান খুব সহজেই শিখে নিতেন। গাইতেনও খুব। লেখাপড়ার চেয়ে গান গাওয়ার প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। পুত্রের এই আগ্রহ দেখে পিতা দুর্গামোহন বললেন, তুমি শিখ। তোমার দ্বারা f যেন আমার বংশের মান-সম্মান উজ্জ্বল হয়।
পিতার উৎসাহেই ললিতমোহন আরও ভালো শেখার জন্য গেলেন ঝাপুড়া কুশানীর (বর্মণ) কাছে। ঝাণুড়া কুশানীর নিজের দল ছিল কুশান পালার। কুশান পালাকে জনপ্রিয় করবার জন্য তাঁর অবদানও অনেক। ললিত তাঁর কাছে শিখে কুশান গানকে আরও এগিয়ে নিয়েছেন। ললিত মোহন মাত্র ষোল বছর বয়সে নিজের কুশান পালার দল 'রামজীবনী ললিত কুশান যাত্রা সমাজ'। পালা বাঁধলেন, দস্যু রত্নাকর, রাজা হরিশ্চন্দ্র, লক্ষ্মনের শক্তিশেল, লব-কুশের পিতৃ পরিচয়, রাম বনবাস ইত্যাদি প্রচলিত কাহিনি অবলম্বনে। দলের কাজ ও সুনাম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে। তিনি কুশান পালা নির্মাণে স্বকীয়তা দেখিয়েছেন।
অত্যন্ত দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই ক'রে ললিত কুশানী এই আঙ্গিকে নতুন পথ নির্মান করেছেন। রামায়ণ নির্ভরতার বাইরে মহাভারত, পুরাণ, ঐতিহাসিক ঘটনাকে পালার উপজীব্য করেছেন। রচনা করেছেন নল-দময়ন্তী, শ্রীবৎস চিন্তা, সাবিত্রী সত্যবান, দাতা কর্ণের দান পরীক্ষা। কোচবিহার রাজার ইতিহাস কেন্দ্র ক'রে রচনা করেছেন 'রাজা কামতেশ্বর'। তাঁর মেধার ছৌযায় কুশান নতুন উত্তরণের দরজা খুলে দিয়েছে। পেয়েছেন মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পেয়েছেন স্বর্ণ-পদক, রৌপ্য-পদক। আব্বাসউদ্দিন স্মরণ সমিতি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ ২০০১ সালে লালন পুরস্তাবে সম্মানিত করেছে। সে বছরই তিনি পরলোক গমন করেছেন। অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও অসম, নেপাল ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়।
মৃত্যুর বছর খানেক আগেই দু'হাজার সালে দীপঙ্কর ঘোষের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রতিভাবান এই শিল্পী কুশানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। তাঁর সেই কথাগুলি আজ বাস্তব। তিনি বলেছেন "ভবিষ্যৎ তো এটা একদম যাত্রায় পরিণত হয্যা যাবে-কুশানটা উচ্ছেদ হয়্যা যাবে। এখন এখানকার যে স্থানীয় বড় বড় যাত্রাগুলো ছিল সেই যাত্রাগুলো তো এখন নাই। এখন ওই যে অভিনেতা অভিনেত্রীগুলো নামকরা এঁরা সব কুশানের মধ্যে ঢুকতেছে। আর আসিয়া যুক্তি দিচ্ছে মালিক পক্ষকে, যে তোমরা দলটাকে এইভাবে করো, ডাবল মঞ্চ করো, ওইটা লাইট লাগাও। বিভিন্ন যুক্তি পরামর্শ দিয়া এই ঠিক অপেরার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কুশানের মর্যাদা কমে যাচ্ছে। এই দশ-বারো বছর হল এইটা বেশি বাড়ছে। আর মালিকপক্ষের একটা বিরাট ব্যবসা আছে। এখন বিভিন্ন নাচওলা ঢুকতেছে-এর মধ্যে হিন্দি এবং অপসংস্কৃতির কতকগুলো নাচটায়ও ঢুকা গেছে এর মধ্যে"।
অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন কথাগুলি। আরও প্রায় কেটেছে একুশ বাইশ বছর। যাত্রা হয়ে ওঠায় ঐতিহ্যের কুশান হারিয়েই গেছে প্রায়। গ্রামে কাজ কমে গেছে। মানুষের প্রাত্যহিক চাহিদা বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক। পুজিবাদী ব্যবস্থার ফাঁদে মানুষ আজ কেবল 'কনজিউমার'। জীবনের সহজ সবল ছন্দ আজ জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার প্রভাব স্বাভাবিক কারণে আমাদের লোকনাটো, লোক সংস্কৃতিতে পড়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনেকেই চেষ্টা করেছেন এবং করছেন কুশানের ঐতিহ্যকে বহমান রাখতে। ললিত কুশানির ছেলে বিনয় কৃষ্ণ বর্মণ খুব চেষ্টা করেছিলেন বাবার প্রতিষ্ঠিত দলটি টিকিয়ে রাখতে। পারলেন না। উল্লেখযোগ্য লড়াই করেছেন ধনেশ্বর বর্মণ (সিতাই), নির্মল দেবনাথ (শৌলমারি), মহিম বর্মণ (মাথাভাঙা), শৈব্যা কুশানী, জীতেন কুশানী (প্যাটলা), নরেন গীদাল (সুবচনীর পাট), বেণুকা কুশানী (গোসানিমারি)।
যাত্রা হয়ে ওঠার আগে কুশান কিছু রীতি মেনে অভিনীত হ'ত। এ তার নিজের বৈশিষ্ট্য। তার সুরের ধরণ একে পৃথক পরিচিতি দিয়েছে। দীর্ঘ কালের চর্চায় গড়ে ওঠা পরিচিতি। কুশানের কাহিনি বিস্তাবে পালা তিনরাত্রি, পাঁচরাত্রি, সাতরাত্রি ধ'রে চলত। আবার একরাত্রেও শেষ হ'ত। আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজার পর থেকে চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে এই পালার আয়োজন করা হয়। এক একটি দলে পনের থেকে কুড়িজন পর্যন্ত পুরুষ ও মহিলা শিল্পী থাকেন। তাঁরাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন, বাদ্যযন্ত্র বাজান, গান গান। মহিলা শিল্পী যেমন থাকেন তেমনই অনেক পুরুষ মাইলার সজ্জায় নৃত্য পরিবেশন করেন ও অভিনয় করেন। তাঁদের 'ছোকরা' বা 'ছুকড়ি' বলা হয় তা আগেই বলেছি। অনেক সংখ্যক মহিলা ইদানিংকালে অংশ গ্রহণ করলেও মুকড়িদের আকর্ষণ কমে নি। অনেক সময়েই মুকড়িদের আবেদন অনেক বেশি থাকে মহিলাদের তুলনায়।
* Abstract (সারাংশ) * Key word:- * Introduction * Conclusion * Reference.
*
No comments:
Post a Comment