VIVEKANANDA COACHING CENTRE
XII HISTORY -2025
1. ‘ অব - শিল্পায়ন ’ বলতে কী বোঝ ? উপনিবেশিক আমলে ভারতে অব - শিল্পায়ন সম্পর্কে আলোচনা করো ।
[a] অব- শিল্পায়ন:-
[b] অব - শিল্পায়নের কারণ :-
[ 1 ] মূলধনের অভাব :- আঠারো শতকে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটানো সম্ভব হয়েছিল । এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় শিল্পগুলিতে মূলধনের জোগান দেওয়া তো দূরের কথা এদের অর্থ ও সম্পদকে কোম্পানি নিংড়ে শোষণ করে নিয়েছিল | ফলে মূলধনের অভাবে অব - শিল্পায়ন ছিল এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ।
[ 2 ] কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য :- দেওয়ানি লাভের পর শুরু হয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের যুগ । অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘ Wealth of Nation ' গ্রন্থে লিখেছেন — ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশ বাণিজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ও ভারতীয় স্বার্থবিরোধী ।
[ 3 ] ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের ধ্বংসসাধন :- এ সময়ে ভারতে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ড ও ইউরোপের প্রত্যেক দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । এ প্রসঙ্গে ড্যানিয়েল ডেফো ‘ রবিনসন ক্রুশো ' গ্রন্থে লিখেছেন— “ ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে , বসার ঘরে , শোয়ার ঘরে , সবজায়গায় ভারতীয় বস্তু ঢুকে পড়েছে । ” তা দেখে ব্রিটিশ শাসকরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে ও ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানিকৃত সুতিবস্ত্রের ওপর শুল্ক চাপায় । এর ফলে ব্রিটেনের ভারতীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা কমে যায় ও দেশীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে ।
[ 4 ] শিল্পবিপ্লব :- ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার অনেক কম সময়ে বেশ উন্নতমানের অথচ সস্তা দ্রব্য উৎপাদন শুরু হয় , যা সহজে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজার দখল করে নেয় । ফলে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প পিছু হটতে বাধ্য হয়।
[ 6 ] অবাধ বাণিজ্যনীতি :-১৮১৩ খ্রি . সনদ আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের অবসান ঘটিয়ে অবাধ বাণিজ্যনীতি গৃহীত হয় । ফলে ইংল্যান্ডের অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ও তখন থেকে অবাধে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করে । ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীতে ভারতীয় বাজার ছেয়ে যায় ।
[c] অব - শিল্পায়নের ফলাফল :-
[ 1 ] বেকারত্ব :-দেশীয় কুটির শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর বেকার হয়ে পড়ে । নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মতে , “ শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ লোক জীবিকা হারিয়েছিল । ”
[ 2 ] কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন :- অব - শিল্পায়নের ফলে কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন সম্পূর্ণ হয় । ফলে , কুটিরশিল্পের বিকল্প জীবিকাক্ষেত্রের অভাবে মানুষ দুর্দশার মুখে পড়ে ।
[ 3 ] শহরগুলির শ্রীহীনতা : -অব - শিল্পায়নের ফলে ভারতের বিভিন্ন শহরগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে। অবশিল্পায়নের ফলে অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কারিগর বেকার হয়ে অন্যত্র চলে যেতে থাকে। ফলে শহর কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়।
[ 4 ] কাঁচামাল সরবরাহের দেশে রূপান্তর :- অব - শিল্পায়নের মাধ্যমে ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছিল কাঁচামাল সরবরাহের দেশে | রেলপথ চালু হলে ভারত থেকে কাঁচা রেশম , নীল , চা , কাঁচা তুলো প্রভৃতি ব্রিটেনে ‘ সরবরাহ শুরু হয় ।
[ 5 ] কৃষির ওপর চাপ বৃদ্ধি:- কাজ হারানো শিল্পী ও কারিগররা বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে কৃষিক্ষেত্রে ভিড় জমায় । ফলে কৃষির ওপর চাপ বাড়ে ।
[ 6 ] গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন :-অব - শিল্পায়নের ফলে ভারতীয় গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ে । অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে কৃষিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে । ফলে কৃষিমরশুম বাদ দিয়ে অন্যসময়ে মানুষের কাজ না থাকায় সার্বিকভাবে গড় আয় কমে যায় ।
2) মুসলিমসমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান উল্লেখ করো ।
অথবা , আলিগড় আন্দোলনের প্রসারে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের কৃতিত্বের পরিচয় দাও ।
উত্তর:-
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় মুসলিমসমাজের সংস্কার ও অগ্রগতির কাজে যিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান ( ১৮১৭-১৮৯৮ খ্রি . ) ।
[a] স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান:-
[ 1 ] পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি সমর্থন :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে আরবি , ফারসি , উর্দু ভাষা ও ইসলামীয় শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন ও পরে ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষতা লাভ করেন । তিনি ভারতের মুসলিমসমাজকে বোঝান যে , মুসলিম সম্প্রদায়ের অগ্রগতির জন্য তাদের ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি ।
[ 2 ] ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য :- মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন । তিনি মুসলিমদের পরামর্শ দেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই মুসলিমসমাজের স্বার্থ নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে ।
[ 3 ] রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রথম জীবনে হিন্দু - মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন । কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে । তিনি | ' পাইওনিয়ার ' পত্রিকায় লেখেন যে , হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি । এদের রাজনৈতিক স্বার্থও পৃথক ।
[ 4 ] শিক্ষার প্রসার :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সম্প্রদায়কে যুক্তিনির্ভর ও স্বাধীন চিন্তাভাবনার অধিকারী হওয়ার পরামর্শ দেন । মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে তিনি গাজিপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় ( ১৮৬৩ খি ) প্রতিষ্ঠা করেন ।তিনি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । পরবর্তীকালে এটি ‘ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ' - এ ( ১৯২০ খ্রি . ) পরিণত হয় ।
[ 5 ] নারীমুক্তি :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিমসমাজে নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার বিস্তারের পক্ষে এবং পর্দাপ্রথা , বহুবিবাহ ও ‘ তালাক ’ দেওয়ার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেন । মানবিকতা ও যুক্তির আলোকে তিনি ইসলামকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হন ।
[6] আলিগড় আন্দোলন :- সৈয়দ আহমদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে পরে মুসলিম সমাজের সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিবর্তিত হয় । মুসলিমসমাজের এই জাগরণ ‘ আলিগড় আন্দোলন ' নামে পরিচিত । এই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চিরাগ আলি , আলতাফ হোসেন আলি , মৌলানা শিবলি নোমানি , নাজির আহম্মদ , খুদা বক্স প্রমুখ ।
মূল্যায়ন :- স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আলিগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিমসমাজে আধুনিকতার ঢেউ লাগে । ঐতিহাসিক ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে , “ হিন্দুসমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য রাজা রামমোহন যা করেছিলেন , মুসলিমসমাজের মঙ্গলের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেন । ”
3) স্বাধীন বাংলাদেশের উথ্বানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা আলোচনা করো ।
সূচনা :- পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে । এর পরিণতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে ।
■ স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবুর ভূমিকা:-
[ 1] পূর্ববঙ্গের প্রতি বদনা :- দেশভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে । পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত থেকে যায় । তারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের দাবিদাওয়ার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখায় । ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয় ।
[2] ভাষা আন্দোলন :- পূর্ব পাকিস্তানে ৯৮.৯৬ শতাংশের বেশি মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা ; অথচ পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্না বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন । পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও মনে করেন যে , বাংলা হল হিন্দুদের ভাষা । এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র আন্দোলন শুরু হয় ।
[ 6 ] শেখ মুজিবরের নেতৃত্ব :- সরকার গঠনে আওয়ামি লিগ ব্যর্থ হলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন । শেখ মুজিবরের ধর্মঘটের ডাকে গোটা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে পড়ে | মুজিবুর ২৫ মার্চ ( ১৯৭১ খ্রি . ) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক সভার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন যে , “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । ” তাঁর ভাষণে পূর্ববঙ্গের গোটা বাঙালি জাতির মধ্যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয় |
[ 7 ] গণহত্যা :- বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠানো হয় । পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয় | ২৫ মার্চ রাতে পাক সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ব্যাপক হারে হত্যা করতে শুরু করে । এই হত্যা অভিযানের পোশাকি নাম দেওয়া হয় ‘ অপারেশন সার্চ লাইট ’ |
[ ৪ ] স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম : - ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শেখ মুজিবুর গ্রেপ্তার হলেও আন্দোলন দমন করা যায়নি | স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও মুক্তি বাহিনী ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে । ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা পূর্ববঙ্গে মুক্তি বাহিনীকে সহায়তা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই পাক বাহিনী বিপাকে পড়ে যায় । শেষপর্যন্ত পাক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ . এ . কে . নিয়াজি ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা - র কাছে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয় ।
উপসংহার : - স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুস্থিতি অধরাই থেকে যায় । স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট আততায়ীর হাতে নিহত হন ।
4) বিশ্বে ঠান্ডা লড়াইয়ে ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনার ভূমিকা কী ছিল ?
উত্তর:-
1 ] ট্রুম্যান নীতি:- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মার্কিন সংসদের এক যৌথ অধিবেশনে টুম্যান বলেন যে , এখন থেকে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে স্বাধীন জনগণ যদি সশস্ত্র সংখ্যালঘু অথবা বাইরের শক্তির আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে , সেক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করাই হবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি । এই ঘোষণাই ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত ।
পটভূমি:-
[ a ] চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা :- ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত মিসৌরি প্রদেশের ফালটন শহরে এক ভাষণে সাম্যবাদের প্রসার রোধ করার লক্ষ্যে ইঙ্গ - মার্কিন যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান ।
[ b ] কেন্নানের বেষ্টনী নীতি :- মার্কিন বিদেশনীতির উপদেষ্টা জজ এফ . কেন্নান সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে এক প্রবন্ধ লিখে জানান , রুশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অহেতুক কোনো যুদ্ধে না গিয়ে আমেরিকার উচিত হবে যে অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাব রয়েছে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা ।
■ উদ্দেশ্যে :-
[ a ] রাজনৈতিক :- যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত বা সাম্যবাদী প্রভাব প্রতিহত করার জন্য প্রতিরোধমূলক রণকৌশল গ্রহণ ।
[ b ] অর্থনৈতিক :- ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল , অর্থসাহায্যের নামে অন্যান্য দেশকে অস্ত্র ও শিল্পজাত ঢুক বিক্রি করে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানো ।
■ মার্শাল পরিকল্পনা:- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্শাল তাঁর ভাষণে বলেন— যুদ্ধবিধবস্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য , মুধা , হতাশা , বেকারত্ন সহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকটমোচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অথসাহায্য দেবে ।
■ পটভূমি :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল । এইসমস্ত দেশ আমেরিকার কাছ থেকে অর্থসাহায্য না পেলে স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে , তখন আর এইসমস্ত দেশকে সাম্যবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করা যাবে না । আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল এই সত্যের পটভূমিকায় তাঁর পরিকল্পনার নীতি গ্রহণ করেন ।
■ উদ্দেশ্য :-
[ a ] সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত ইউরোপ গঠন :- যুদ্ধবিধৰস্তু ইউরোপের দেশগুলিকে অর্থসাহায্য দিয়ে তাদের সোভিয়েত প্রভাব থেকে মুক্ত করা ।
[ b ] মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা :- অর্থসাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলির অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও মার্কিন আধিপত্য কায়েম করা ।
প্রয়োগ :- ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে পশ্চিম জার্মানি সহ পশ্চিম ইউরোপের ১৬ টি দেশ মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল । এইসমস্ত দেশ মিলিত হয়ে গঠন করেছিল OEEC ( Organisation for European Economic Cooperation ) বা ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা " ।
5) বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি আলোচনা করো। এর সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
• নবজাগরণ:- উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা, ধর্মীয় উদারতা, সমাজসংস্কার, আধুনিক সাহিত্যের বিকাশ প্রভৃতি শুরু হয়। ফলে ঊনবিংশ শতকে বাংলার সমাজ- সংস্কৃতিতেও ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। এই অগ্রগতিকে কেউ কেউ উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ' বলে অভিহিত করেছেন।
• নবজাগরণের প্রসার:- উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতি বা নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতা থেকে এই অগ্রগতির ধারা পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে রাজা রামমোহন রায়ের সময়কে এই জাগরণের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
•বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি:- পঞ্চদশ শতকে সংঘটিত ইউরোপের নবজাগরণের সঙ্গে অনেকে উনিশ শতকে সংঘটিত বাংলার নবজাগরণের তুলনা করেছেন। এর ফলে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
(A) সীমিত পরিসর:- উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ব্যাপ্তি বা পরিসর ছিল খুবই সীমিত। তা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক। কলকাতার বাইরে গ্রামবাংলায় এই নবজাগরণের প্রসার ঘটেনি এবং গ্রামবাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই নবজাগরণের কোনো সুফল পায়নি।
(B) মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধতা: বাংলার জাগরণ শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই সমাজের লোকেদের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বলে অভিহিত করেছেন এজন্য অধ্যাপক অনিল শীল এই জাগরণকে এলিটিস্ট আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন।
(C) ব্রিটিশ নির্ভরতা: বাংলার এই জাগরণ অতিমাত্রায় ব্রিটিশ নির্ভর হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনের দ্বারাই ভারতীয় সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে।
(D) হিন্দু জাগরণবাদ:- বাংলার নবজাগরণ প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাগরণবাদের পর্যবসিত হয়। রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের কার্যকলাপে হিন্দু জাগরণবাদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। আবার, রামমোহন ও বিদ্যাসাগরও হিন্দুশাস্ত্রকে ভিত্তি করেই সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন।
• নবজাগরণ মতবাদের বিতর্ক:-
পক্ষে:- ঐতিহসিক যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার প্রমুখ উনিশ শতকের অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। স্যার যদুনাথ সরকার তার হিস্ট্রি অব বেঙ্গল গ্রন্থে উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে নবজাগরণ' বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন, ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড়ো উপহার হল আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ।
বিপক্ষে:- নবজাগরণ' অভিধার বিপক্ষে অশোক মিত্র, বিনয় ঘোষ, সুপ্রকাশ রায়, ড. বরুণ দে, ড. সুমিত সরকার প্রমুখ উনিশ শতকে বাংলার বৌশিক অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলে স্বীকার করেন না। অশোক মিত্র সেন্সাস রিপোর্টে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে তথাকথিত নবজাগরণ" বলে অভিহিত করেছেন।
সীমাবদ্ধতা:
(1) ইটালির ফ্লোরেন্স নগরী ইউরোপের নবজাগরণে যে ভূমিকা পালন করে বাংলার কলকাতা তা করতে পারেনি।
(ii) ফ্লোরেন্সের মতো স্বাধীন মানসিকতা ও শিল্পীমন কলকাতার ছিল না।
(iii) উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। কৃষক-এই নবজাগরণের অংশ হতে পারেনি। - শ্রমিকসহ সমাজের একটি বড়ো অংশ
(iv) বাংলার নবজাগরণ ছিল ম মূলত বর্ণহিন্দুদের। মুসলিম সমাজ। এর বাইরে ছিল।
(v) বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তারা বাংলার সমাজকাঠামো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করেনি।
6. ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো।
Ans. ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে রেলপথের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার এ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিঘাত এনেছিল। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে ইংল্যান্ড থেকে আগত গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানি ভারতে রেলপথ স্থাপনের দায়িত্ব পায়। 1853 খ্রিস্টাব্দের 16 এপ্রিল বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত 21 মাইল পথে এ দেশে প্রথম রেল-যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
■ রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য:
① সহজে কাঁচামাল রপ্তানি: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হলে শিল্পের প্রয়োজনে এ দেশের সহজলভ্য কাঁচামাল ইংল্যান্ডে পাঠানোর তাগিদ দেখা যায়। কোম্পানি তাই কাঁচামাল উৎপাদনক্ষেত্রে সঙ্গে বন্দরের রেল-যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী হয়।
② ব্রিটিশ পণ্যের সহজ আমদানি: ব্রিটিশ কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ভারতের বাজারে আমদানি ও বিক্রয় সহজ করার লক্ষ্যে রেল যোগাযোগ গুরুত্বপূণ হয়ে ওঠে।
③ উদ্বৃত্ত ব্রিটিশ পুঁজির বিনিয়োগ: ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোলে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা আসে। তাই ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা পুঁজি বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্র অনুসন্ধান করছিল এবং এক্ষেত্রে তারা ভারতকে বেছে নিয়েছিল।
④ রাজনৈতিক কারণ: ভারতের যে-কোনো প্রান্তে দ্রুত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংবাদ, আধিকারিকদের যাতায়াত, জরুরি পরিসেবা পৌঁছোনো এবং সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কঠোর করার জন্য রেলপথ স্থাপন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
⑤ সামরিক কারণ: ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রয়োজনে রেলপথ স্থাপনের দরকার পড়ে।
■ প্রভাব: ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র তাঁর 'Rise and Groth of Economic Nationalism is India' গ্রন্থে লিখেছেন যে, ভারতে রেলব্যবস্থার বিকাশ ভারতীয় জনজীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে।
■ ইতিবাচক প্রভাব:
① রাজনৈতিক সংহতি: রেলপথ আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষকে একটি বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার অধীনে এনে এ দেশে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠা করে।
② সুগম পরিবহণ: পরিবহণের ক্ষেত্রে রেলপথ বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এতদিনের অগম্য স্থানে রেলপথের কল্যাণে সহজেই যাতায়াত শুরু হয়।
③ বৈদেশিক যোগাযোগ : রেলপথ ভারতীয় কৃষিজ উৎপাদনের আন্তর্জাতিক পরিচিতির সুযোগ সৃষ্টি করে। উৎপাদনক্ষেত্রের সঙ্গে বন্দরের যোগাযোগ গড়ে উঠলে ভারতীয় কৃষিপণ্য বিদেশে পৌঁছে যায়।
④ রপ্তানি ও আমদানি বৃদ্ধি: রেল-যোগাযোগ দেশের মধ্যে ও দেশের বাইরে বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধি করে। ফলে বিদেশে ভারতীয় কাঁচামালের রপ্তানি বাড়ে এবং বিদেশ থেকে এ দেশে আমদানিও বৃদ্ধি পায়।
■ নেতিবাচক প্রভাব: ভারতীয় জাতীয়তাবাদী লেখকগণ এ দেশে ব্রিটিশ সরকারের রেলপথ স্থাপনের নেতিবাচক প্রভাবকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
① ভারতীয় সম্পদের নির্গমন: দাদাভাই নওরোজি, রমেশচন্দ্র দত্তসহ একাধিক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক মনে করেছেন রেল কোম্পানিগুলির 5 শতাংশ নিশ্চিত লাভের ব্যবস্থা করে ব্রিটিশ সরকার এদেশ থেকে সম্পদ নির্গমনের ব্যবস্থা পাকা করে।
② অনুসারী শিল্পের অভাব: রেলের মত ভারী শিল্পের বিকাশ বিপুল সংখ্যায় অনুসারী শিল্পের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারত। কিন্তু এদেশে তা হয়নি। কারণ ভারতীয় রেলের যাবতীয় উপকরণ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হত।
③ বৈষম্যমূলক কর্মসংস্থান: রেলের প্রায় কোনো উচ্চপদেই ভারতীয়দের নিয়োগ করা হত না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছিল।
উপসংহার: ভারতে ব্রিটিশের রেলব্যবস্থা এ দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থে কখনোই পরিচালিত হয়নি। এ দেশের রেল ব্রিটিশ পুঁজির নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র ছিল।
7) ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ দাও?
উ:- ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে সর্বাধিক শোষিত ও নির্যাতিত ছিল আদিবাসী ও দলিত শ্রেণির মানুষরা। সমাজের উঁচু ও ধনী শ্রেণির মানুষদের দ্বারা এইসব আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক সুযোগসুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল। এই আর্থ-সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে একসময় তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে তোলে। তবে নিম্নবর্গের মধ্যে আদিবাসী সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডা এবং দলিত শ্রেণির মধ্যে নমঃশূদ্র, রাজবংশী, কোচ প্রভৃতি শ্রেণির মানুষেরাই ছিল প্রধান।
● আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিবরণ:- ঔপনিবেশিক শাসনকালে সরল সাদাসিধে আদিবাসী বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার ও শোষণের শিকার হয় যা ছিল নিম্নরূপ-
• কর আরোপ: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সরকার যে ভূমিবন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিল সেখানে করের বোঝা ছিল অত্যন্ত বেশি যার বিরুদ্ধে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল।
• দিকুদের ভূমিকা: আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপর বহিরাগত জমিদার, জোতদার, বণিক, মহাজন, দালাল শ্রেণির মানুষেরা অর্থাৎ দিকুরা বিভিন্ন কৌশলে শোষণ করত যা ছিল আদিবাসীদের জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
• সামাজিক আগ্রাসনের শিকার ঔপনিবেশিক শাসনকালে আদিবাসী সম্প্রদায় সামাজিক আগ্রাসনেরও শিকার হয়েছিল। নতুন পাশ্চাত্য খ্রিস্টান সংস্কৃতির প্রভাবে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়।
■ দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ: ব্রিটিশ শাসনকালে শোষিত ও নির্যাতিত এই পশ্চাৎপদ সম্প্রদায় এককথায় 'দলিত' নামে পরিচিত।
• ভাষাগত সমস্যা: দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা আঞ্চলিক ভাষায় অভ্যস্থ প্রতি আকৃষ্ট ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণরা দলিত শ্রেণির এই কথ্য ভাষাকে খুবই অবজ্ঞার চোখে দেখত।
• বাংলায় দলিতদের সক্রিয়তা: দলিত সম্প্রদায়ের একাধিক সমস্যার বিষয়ে সরব হয়েছেন বেশ কিছু দলিত নেতা। যেমন-হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং পূর্ববঙ্গের দলিত নেতাদের মধ্যে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্র মন্ডল প্রমুখ।
• আম্বেদকরের উদ্যোগ :- ব্রিটিশ শাসনকালে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার এর চেয়ে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দূরবস্থার অবসান ঘটানোর উপর আম্বেদকর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ১৯২৭খ্রিস্টাব্দে দলিত শ্রেণির মানুষদের নিয়ে মহারাষ্ট্রে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন।
■ মূল্যায়ন: উপরের আলোচনায় স্পষ্ট যে ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে আদিবাসী ও দলিত শ্রেণির মানুষের উপর সুদীর্ঘকালের অত্যাচারের অবসান ঘটেছিল বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত একাধিক আদিবাসী ও দলিত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। আদিবাসী ও দলিত শ্রেণির মানুষদের নিয়ে যে দীর্ঘ দিনের সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য তার অবসানও কিছুটা সম্ভব হয়েছিল এই সব আন্দোলন ও প্রতিবাদের মাধ্যমে।
9) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি ও অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
উত্তর:-
■ সূচনা: ক্লিপস প্রস্তাব ব্যর্থ হলে ভারতীয় জনমানসে তীব্র অসন্তোষের জন্ম নেয় এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে। ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বশেষ বৃহৎ গণপ্রচেষ্টা হল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। গান্ধিজি ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যে 'হরিজন' পত্রিকায় লেখেন (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে)- "ভারতকে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও, যদি এটা খুব বেশি বলে মনে হয় তা হলে তাকে নৈরাজ্যের হাতে ছেড়ে চলে যাও” (Leave India to God. If that is too much, then leave her to anarchy.) ।
■ আন্দোলনের সূচনা: বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির বিপুল ভোটে গান্ধিজির ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাস হয়। ঘোষণা করা হয় ৯ আগস্ট থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। গান্ধিজি জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন- "পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট নই। ... হয় সিদ্ধিলাভ, নয় মৃত্যু। ভারত স্বাধীন করব, অথবা মৃত্যুবরণ করব-'Do or Die' (করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে)।" নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির অধিবেশন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোম্বাই রেলস্টেশন থেকে গভীর রাতে গান্ধিজি, জওহরলাল, প্যাটেল, আজাদ ও জে. বি. কৃপালনি-সহ শীর্ষ নেতাদের ব্রিটিশ গ্রেফতার করে। পরের দিন সকালে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে হরতাল, বিক্ষোভ, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন বিদ্যুৎ গতিতে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
■ বিস্তার:- বাংলায় আগস্ট আন্দোলনের মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুর, হুগলি-সহ বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এই আন্দোলন সবথেকে তীব্র আকার ধারণ করে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে। বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজাফ্ফরপুর, পূর্ণিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গান্ধিজির 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' ধ্বনি জনগণকে স্বাধীনতালাভে ব্যাকুল করে।
■ ব্রিটিশের দমননীতি:- আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার নিষ্ঠুর দমননীতি গ্রহণ করে। গুলিচালনা, গ্রেপ্তার, জরিমানা, লাঠিচালনা, বেতের আঘাত এমনকি বিমান থেকে গোলাবর্ষণও করা হয়। জওহরলাল নেহরুর মতে, পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ১০,০০০ জন এর কাছাকাছি। সারা দেশে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হয়। এমনকি বিমান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়।
■ ব্যর্থতার কারণ: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার বিভিন্ন কারণ ছিল। এই কারণগুলি হল-
①-নেতৃত্বের অভাব: নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। গান্ধিজি-সহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ থাকায় এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত নেতা ছিল না।
② ঐক্যের অভাব: মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, কেউই আন্দোলন সফল করার জন্য কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি। এই দলগত ঐক্যের অভাব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।
③ ব্রিটিশের পীড়ন নীতি: ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি আন্দোলনকে সফল হতে দেয়নি। দৈহিক নির্যাতন, গ্রেফতার, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষণ, এমনকি গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়।
④অসময়ে সূচনা: ভুল সময়ে এই আন্দোলন শুরু হওয়ায় আন্দোলন সফল হয়নি বলে মনে করা হয়। কারণ যে সময় আন্দোলন শুরু করা হয় তখন বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি মিত্রপক্ষের অনুকূলে আসতে শুরু করে। সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গাম্বি অনুগামীরা তখন তা অনুমোদন করেননি।
■ গুরুত্ব:-
① কংগ্রেসের মর্যাদাবৃদ্ধিতে: ঐতিহসিক বিপান চন্দ্রের মতে, কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে চূড়ান্ত পর্যায়। এই আন্দোলনের পর কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
② সাম্প্রদায়িক ঐক্য: এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে। মুসলিম লিগ এই আন্দোলনে যোগ না দিলেও বহু মুসলিম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন ও সহায়তা করে।
③ জাতীয় জাগরণে: ১৯৪২-এর আন্দোলন যেভাবে জাতীয় ২৫০২ জাগরণ ঘটিয়েছিল ইতিপূর্বে তা আর দেখা যায়নি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সরকারের বিরোধিতায় গণ-আন্দোলনে অংশ নেয়।
10) জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দাও। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কীরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল?
উত্তর:-
■ সূচনা: ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইন নামে এক নগ্ন দমনমূলক আইন পাস করলে সারা ভারতে প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে যায়। এই আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে প্রতিবাদ আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করলে সরকার আন্দোলন প্রতিহত করতে নিষ্ঠুর দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। এই দমননীতির সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড।
■ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ:- পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে ১৩ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রি.) হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। সামরিক শাসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও' ডায়ার অমৃতসরের শাসনভার গ্রহণের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তিনি ১২ এপ্রিল অমৃতসরে নির্বিচারে গ্রেপ্তার শুরু করেন এবং সভাসমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই অবস্থায় কুখ্যাত রাওলাট আইন, ব্রিটিশ সরকারের তীব্র দমনপীড়ন প্রভৃতির প্রতিবাদে অমৃতসরের পূর্বদিকে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে পূর্বনির্ধারিত একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ যোগ দেয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে সভা শুরু হওয়ার পর জেনারেল ডায়ার বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং আগে থেকে কোনো সতর্কবার্তা না দিয়ে সেনাবাহিনীকে সমাবেশের জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন।
■ হত্যালীলা: জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশ স্থলটি চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সভাস্থলে প্রবেশের জন্য মাত্র একটি এবং সভাস্থল থেকে বেরোনোর চারটি সরু গলিপথ ছিল। ফলে অধিকাংশ মানুষ মাঠ থেকে দ্রুত পালাতে ব্যর্থ হয় এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। সরু গলিপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে বহু লোকের মৃত্যু হয়। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ১২০০ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিশু, নারী-সহ অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষ ঘটনাস্থলে মারা গিয়েছিল। এই ঘটনা 'জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড' নামে পরিচিত।
■ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া:-
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ঘটনায় ভারতবাসীর কাছে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্নরূপটি প্রকাশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায় গুলি চালানোর ঘটনাকে সমর্থন করে। ভারত-সচিব মন্টেগু এই হত্যাকান্ডের ঘটনাকে 'নিবারণমূলক হত্যাকাণ্ড' বলে অভিহিত করেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারতীয়রা এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন। গান্ধিজিও ব্রিটিশদের দেওয়া 'কাইজার-ই-হিন্দ' উপাধি ত্যাগ করেন। গান্ধিজি এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদস্বরূপ তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, "এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।"
12) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের বিভিন্ন শর্তগুলি উল্লেখ করো।
উত্তর:-
■ মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলি:-
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার ভারতীয়দের ক্ষোভ প্রশমন করতে পারেনি। এর এক দশক পরে ভারত সচিব মন্টেগু ও ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের যৌথ রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারত শাসন আইন পাস হয়। এটি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার বা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত। এই আইনের প্রধান শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ-
1) ক্ষমতা বণ্টন: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টিত হয়।
● কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, রেলব্যবস্থা, মুদ্রাব্যবস্থা, বৈদেশিক সম্পর্ক আয়কর, শুদ্ধ, বাণিজ্য, ডাকব্যবস্থা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
● প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা: প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, ভূমিরাজস্ব, যোগাযোগব্যবস্থা প্রভৃতি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
● কেন্দ্রীয় আইনসভা: ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠন করা হয়। এর বিশেষ দিকগুলি ছিল-
● দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা কেন্দ্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর নিম্নকক্ষের নাম হয় 'কেন্দ্রীয় আইনসভা' (Legislative Assembly) এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় 'রাষ্ট্রীয় পরিষদ' Council of States) |
● সদস্যসংখ্যা: উচ্চকক্ষের ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন বড়োলাটের দ্বারা মনোনীত ও ৩৪ জনকে নির্বাচিত এবং নিম্নকক্ষের ১৪০ (পরে ১৪৫) জন সদস্যের মধ্যে ৪০ জনকে মনোনীত এবং ১০০ (পরে ১০৫) জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। উভয় কক্ষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
● প্রাদেশিক দ্বৈতশাসন: মন্টেণু-চেমসফোর্ড আইনের বারা গুদেশগুলিতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর ৭০ শতাংশ সদস্য নির্বাচিত ও ৩০ শতাংশ সদস্য গভর্নরের দ্বারা মনোনীত করার ব্যবস্থা হয়। প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্বগুলিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা-সংরক্ষিত বিষয় এবং হস্তান্তরিত বিষয়। সংরক্ষিত বিষয়গুলি ছিল। আইন-শৃঙ্খলা, অর্থ, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার, শ্রম প্রভৃতি। প্রাদেশিক গভর্নর ও তাঁর কার্যনির্বাহক সভার ওপর এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। হস্তান্তরিত বিষয়গুলি ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্বশাসন প্রভৃতি। এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে।
13) পেশাদারি শাখা হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব লেখো।
উত্তর:- ইতিহাস মানুষের অতীতকে জানতে সাহায্য করে। তাই বলা হয় ইতিহাস হল মানব জাতির অতীত কর্মকাণ্ডের কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিক লিখিত বিবরণ। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ খুকিডিডিস ইতিহাসের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন যে, "অতীত কালে যা ঘটেছে তার সঠিক জ্ঞান ভবিষ্যতে প্রয়োজন আসবে, কারণ মানুষের কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্যতার নিরিখে ভবিষ্যতেও একই ধরনের ঘটনা পুনরায় সংঘটিত হবে।"
(1) ইতিহাসের গুরুত্ব:- ঐতিহাসিক তার মনের আয়নায় অতীতকে দেখেন এবং তা প্রকাশ করেন। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব, সভ্যতার উদয় ও অগ্রগতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি সমস্ত কিছুরই ধারণা দেয় ইতিহাস। ঐতিহাসিকের কাজ হল শুধুমাত্র অতীত পুনর্গঠন করা এবং অতীত ঘটনাগুলিকে পরিবর্তিত বা বিকৃত না করে উপস্থাপিত করা।"
(2) জ্ঞানের বিকাশ:- জ্ঞানের একটি শাখারূপেই ইতিহাস জ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জ্ঞানের ভান্ডারে পরিণত হয়। ইতিহাসে আমরা খুঁজে পাই পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভৌগোলিক অবস্থান, সাহিত্যিক বিবর্তন,
(3) ভাষার বৈচিত্র্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞানের মানবক্রিয়া এবং অর্থনীতির নানারূপ। এ ছাড়াও মানব বিবর্তন, সভ্যতার উত্থানপতন, সাম্রাজ্যের উত্থানপতন, সমকালীন সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কারকাজ, মহাপুরুষদের উদ্যোগ, বিদ্রোহ, বিপ্লব, আন্দোলন প্রভৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করা যায় ইতিহাস থেকে।
(4) ঘটনার ধারাবাহিকতার অনুধাবনে:- ইতিহাস এই সমস্ত কিছুকেই ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে শুরু করে প্রায়-ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক পর্বের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে উঠে আসে। ইতিহাস প্রাচীন যুগের নিদর্শনগুলি মধ্যযুগে এবং মধ্যযুগের নিদর্শনগুলি আধুনিক যুগের মানুষের কাছে উপস্থাপন করে। ইতিহাস পাঠের দ্বারা বর্তমান প্রজন্ম অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা যুগের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ঘটনাগুলির সম্যক ধারণা লাভ করে। ইতিহাস সদা প্রবহমান, বহমান নদীর মতো, থেমে থাকে না।"
(5) অতীত ও বর্তমালের মধ্যে সম্পর্কস্থাপনে:- ইতিহাস অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করে। তাই ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড হ্যালেট কার (E.H. Carr) বলেছেন, "ইতিহাস হল বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ। "ঐতিহাসিক কার আরও বলেছেন, বর্তমান যেমন অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। তেমনি অতীতকেও দেখা হয় বর্তমানের আলোকে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া চলতে থাকে।
(6) বর্তমানের ভিত্তি নির্মাণে: অতীতের ভিতের ওপর বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে। এই বর্তমানকে জানা ও বোঝার জন্য অতীত ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। আসলে ঐতিহাসিক বর্তমানের চোখে অতীতকে দেখে থাকেন। তিনি বর্তমানের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা অতীতের ওপর প্রয়োগ করে থাকেন। ফলশ্রুতি হিসেবে অতীত বর্তমানরূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় তথ্যের দ্বারা ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকালে বর্তমানের প্রভাবে প্রভাবিত হন। ফলে ঐতিহাসিকের সত্য বর্তমানের সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
(7) জাতীয়তাবাদের ও দেশপ্রেমের বিকাশে:- ইতিহাস জনগণকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ও দেশপ্রেমে জাগ্রত করে। ইতিহাস থেকেই বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ উন্মোচিত হয়।
14) অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি বা মিথ এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা আলোচনা করো।
■ সূচনা: প্রাচীন কাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মনে যে চেতনা ও ভাবধারার সৃষ্টি হয় তারই প্রতিফলন হলো ইতিহাস। মিথ শব্দটি এসেছে 'Muthos' থেকে যা একটি গ্রিক শব্দ। মিথ বা কিংবদন্তির নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন কাল্পনিক ও অলৌকিক চরিত্র রয়েছে যেগুলি শতকব্যাপী প্রচারিত হয়ে আসছে যা মিথ নামে পরিচিত।
অন্যদিকে স্মৃতিকথা প্রতিটি মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা লুকিয়ে রাখে। সেগুলি সে লিখে রাখতে পারে যা পরবর্তীতে কাউকে জানাতে বা পড়াতে পারে। আসলে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির নিজ জীবনের বিভিন্ন ছোটো-বড়ো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ যখন লিপিবদ্ধ আকারে পাওয়া যায় তা স্মৃতিকথা নামে পরিচিত হয়।
■ অতীত স্মরণ করার ক্ষেত্রে মিথ বা কিংবদন্তির অবদান:-
• বিশ্বজনীনতা: মিথ বা কিংবদন্তির বিবরণ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়। বিশ্ব সৃষ্টি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি ঘটনার আভাসও এই কাহিনিগুলি প্রদান করে।
• সময়কাল নির্ণয়ে:- তুলনামূলক যাচাই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মিথের কাহিনিগুলি থেকে ইতিহাসের বহু সাল, তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
• ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে:- কিংবদন্তির মাধ্যমে উঠে আসা কাহিনিগুলিকে ঐতিহাসিক উপাদানের সূত্র হিসেবে ধরা হয়। যেমন-মিথের কাহিনির সূত্র ধরেই আধুনিক ঐতিহাসিকগণ ট্রয় নগরী, বা ট্রয়ের যুদ্ধের স্থান নির্ণয় করেছেন। আবার ভারতে প্রচলিত মৌর্য সম্রাট অশোক, রানি দুর্গাবতী, মীরাবাঈ-এর বীরত্বের কাহিনি জাতীয় বীরের মর্যাদায় তাঁদের উন্নীত করে। এসবই জানা যায় থেকে।
■ অতীত স্মরণে স্মৃতিকথার ভূমিকা:
• বাস্তবভিত্তিক ধারণা: স্মৃতিকথা কোনো কাল্পনিক ঘটনা নয়, এর বাস্তব ভিত্তি অনেক বেশি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার সময়ে উদ্বাস্তুদের জীবনযন্ত্রণার মর্মস্পর্শী সত্য বহু মানুষের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।
• নির্দিষ্ট স্থান ও কালের ধারণা:- বেশিরভাগ সময় স্মৃতিকথা থেকে নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তির স্মৃতিচারণায় তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিফলন দেখা যায়।
• ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ:- ইতিহাস রচনার অন্যতম উপাদান হলো স্মৃতিকথায় কোনো আঞ্চলিক ইতিহাস বা তথ্যের অভাব দেখা দিলে স্মৃতিকথাগুলি সহায়ক উপাদানের ভূমিকা পালন করে।
• নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের জীবনী: স্মৃতিকথা থেকে কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের বা সাধারণ মানুষের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সত্যতা প্রকাশ পায়। স্মৃতিকথায় কোনো ঘটনা অতিরঞ্জন করে দেখানো হয় না।
No comments:
Post a Comment