Monday, December 18, 2023

অব - শিল্পায়নের কারণ&আলিগড় আন্দোলন &শেখ মুজিবুর

1. ‘ অব - শিল্পায়ন ’ বলতে কী বোঝ ? উপনিবেশিক আমলে ভারতে অব - শিল্পায়ন সম্পর্কে আলোচনা করো । 3 + 5

অব- শিল্পায়ন:- 

 অব - শিল্পায়নের কারণ :-

[ 1 ] মূলধনের অভাব :- আঠারো শতকে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটানো সম্ভব হয়েছিল । এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় শিল্পগুলিতে মূলধনের জোগান দেওয়া তো দূরের কথা এদের অর্থ ও সম্পদকে কোম্পানি নিংড়ে শোষণ করে নিয়েছিল | ফলে মূলধনের অভাবে অব - শিল্পায়ন ছিল এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা । 

[ 2 ] কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য :- দেওয়ানি লাভের পর শুরু হয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের যুগ । অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘ Wealth of Nation ' গ্রন্থে লিখেছেন — ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশ বাণিজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ও ভারতীয় স্বার্থবিরোধী । 

 [ 3 ] ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের ধ্বংসসাধন :- এ সময়ে ভারতে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ড ও ইউরোপের প্রত্যেক দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । এ প্রসঙ্গে ড্যানিয়েল ডেফো ‘ রবিনসন ক্রুশো ' গ্রন্থে লিখেছেন— “ ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে , বসার ঘরে , শোয়ার ঘরে , সবজায়গায় ভারতীয় বস্তু ঢুকে পড়েছে । ” তা দেখে ব্রিটিশ শাসকরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে ও ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানিকৃত সুতিবস্ত্রের ওপর শুল্ক চাপায় । এর ফলে ব্রিটেনের ভারতীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা কমে যায় ও দেশীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে ।

 [ 4 ] শিল্পবিপ্লব :- ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার অনেক কম সময়ে বেশ উন্নতমানের অথচ সস্তা দ্রব্য উৎপাদন শুরু হয় , যা সহজে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজার দখল করে নেয় । ফলে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প পিছু হটতে বাধ্য হয়।

[ 6 ] অবাধ বাণিজ্যনীতি :-১৮১৩ খ্রি . সনদ আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের অবসান ঘটিয়ে অবাধ বাণিজ্যনীতি গৃহীত হয় । ফলে ইংল্যান্ডের অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ও তখন থেকে অবাধে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করে । ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীতে ভারতীয় বাজার ছেয়ে যায় । 

অব - শিল্পায়নের ফলাফল :-

[ 1 ] বেকারত্ব :-দেশীয় কুটির শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর বেকার হয়ে পড়ে ।  নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মতে , “ শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ লোক জীবিকা হারিয়েছিল । ” 

[ 2 ] কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন :- অব - শিল্পায়নের ফলে কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন সম্পূর্ণ হয় । ফলে , কুটিরশিল্পের বিকল্প জীবিকাক্ষেত্রের অভাবে মানুষ দুর্দশার মুখে পড়ে । 

[ 3 ] শহরগুলির শ্রীহীনতা : -অব - শিল্পায়নের ফলে ভারতের বিভিন্ন শহরগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে। অবশিল্পায়নের ফলে অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কারিগর বেকার হয়ে অন্যত্র চলে যেতে থাকে। ফলে শহর কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়।

 [ 4 ] কাঁচামাল সরবরাহের দেশে রূপান্তর :- অব - শিল্পায়নের মাধ্যমে ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছিল কাঁচামাল সরবরাহের দেশে | রেলপথ চালু হলে ভারত থেকে কাঁচা রেশম , নীল , চা , কাঁচা তুলো প্রভৃতি ব্রিটেনে ‘ সরবরাহ শুরু হয় ।

[ 5 ] কৃষির ওপর চাপ বৃদ্ধি:- কাজ হারানো শিল্পী ও কারিগররা বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে কৃষিক্ষেত্রে ভিড় জমায় । ফলে কৃষির ওপর চাপ বাড়ে । 

[ 6 ] গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন :-অব - শিল্পায়নের ফলে ভারতীয় গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ে ।  অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে কৃষিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে । ফলে কৃষিমরশুম বাদ দিয়ে অন্যসময়ে মানুষের কাজ না থাকায় সার্বিকভাবে গড় আয় কমে যায় ।

2)  মুসলিমসমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান উল্লেখ করো ।

 অথবা , আলিগড় আন্দোলনের প্রসারে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের কৃতিত্বের পরিচয় দাও । 

উত্তর:-

  ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় মুসলিমসমাজের সংস্কার ও অগ্রগতির কাজে যিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান ( ১৮১৭-১৮৯৮ খ্রি . ) । 

স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান:-

 [ 1 ] পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি সমর্থন :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে আরবি , ফারসি , উর্দু ভাষা ও ইসলামীয় শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন ও পরে ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষতা লাভ করেন । তিনি ভারতের মুসলিমসমাজকে বোঝান যে , মুসলিম সম্প্রদায়ের অগ্রগতির জন্য তাদের ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি ।

 [ 2 ] ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য :-  মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন । তিনি মুসলিমদের পরামর্শ দেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই মুসলিমসমাজের স্বার্থ নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে । 

[ 3 ] রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রথম জীবনে হিন্দু - মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন । কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে । তিনি | ' পাইওনিয়ার ' পত্রিকায় লেখেন যে , হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি । এদের রাজনৈতিক স্বার্থও পৃথক ।

 [ 4 ] শিক্ষার প্রসার :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সম্প্রদায়কে যুক্তিনির্ভর ও স্বাধীন চিন্তাভাবনার অধিকারী হওয়ার পরামর্শ দেন । মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে তিনি গাজিপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় ( ১৮৬৩ খি ) প্রতিষ্ঠা করেন ।তিনি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । পরবর্তীকালে এটি ‘ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ' - এ ( ১৯২০ খ্রি . ) পরিণত হয় ।

 [ 5 ] নারীমুক্তি :- স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিমসমাজে নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার বিস্তারের পক্ষে এবং পর্দাপ্রথা , বহুবিবাহ ও ‘ তালাক ’ দেওয়ার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেন । মানবিকতা ও যুক্তির আলোকে তিনি ইসলামকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হন ।

[6] আলিগড় আন্দোলন :- সৈয়দ আহমদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে পরে মুসলিম সমাজের সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিবর্তিত হয় । মুসলিমসমাজের এই জাগরণ ‘ আলিগড় আন্দোলন ' নামে পরিচিত । এই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চিরাগ আলি , আলতাফ হোসেন আলি , মৌলানা শিবলি নোমানি , নাজির আহম্মদ , খুদা বক্স প্রমুখ । 

মূল্যায়ন :- স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আলিগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিমসমাজে আধুনিকতার ঢেউ লাগে । ঐতিহাসিক ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে , “ হিন্দুসমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য রাজা রামমোহন যা করেছিলেন , মুসলিমসমাজের মঙ্গলের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেন । ”

3) স্বাধীন বাংলাদেশের উথ্বানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা আলোচনা করো । 

 সূচনা :- পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ  জমতে থাকে । এর পরিণতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে ।

 স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবুর ভূমিকা:-

[ 1] পূর্ববঙ্গের প্রতি বদনা :-  দেশভাগের  পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু  করে । পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত থেকে যায় । তারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের দাবিদাওয়ার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখায় । ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয় । 

[2]  ভাষা আন্দোলন :- পূর্ব পাকিস্তানে ৯৮.৯৬ শতাংশের বেশি মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা  ; অথচ পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্না বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন । পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও মনে করেন যে , বাংলা হল হিন্দুদের ভাষা । এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র আন্দোলন শুরু হয় ।

 [ 6 ] শেখ মুজিবরের নেতৃত্ব :-  সরকার গঠনে আওয়ামি লিগ ব্যর্থ হলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন । শেখ মুজিবরের ধর্মঘটের ডাকে গোটা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে পড়ে | মুজিবুর ২৫ মার্চ ( ১৯৭১ খ্রি . ) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক সভার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন যে , “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । ” তাঁর ভাষণে পূর্ববঙ্গের গোটা বাঙালি জাতির মধ্যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয় |

 [ 7 ] গণহত্যা :- বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠানো হয় । পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয় | ২৫ মার্চ রাতে পাক সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ব্যাপক হারে হত্যা করতে শুরু করে । এই হত্যা অভিযানের পোশাকি নাম দেওয়া হয় ‘ অপারেশন সার্চ লাইট ’ | 

[ ৪ ] স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম : - ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শেখ মুজিবুর গ্রেপ্তার হলেও আন্দোলন দমন করা যায়নি | স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও মুক্তি বাহিনী ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে । ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা পূর্ববঙ্গে মুক্তি বাহিনীকে সহায়তা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই পাক বাহিনী বিপাকে পড়ে যায় । শেষপর্যন্ত পাক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ . এ . কে . নিয়াজি ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা - র কাছে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয় ।

উপসংহার : - স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুস্থিতি অধরাই থেকে যায় । স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট আততায়ীর হাতে নিহত হন ।


No comments:

Post a Comment