B.A CBPBU 1st Sem Minor 1 Bengali Question
1. চর্যাপদ কে কোথা থেকে কত সালে আবিস্কার করেন ? চর্যাপদের আবিস্কার কাল , ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করো । চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য আলোচনা করো । 2+3+5 ***
Ans:- বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম গ্রন্থটির নাম চর্যাপদ। চর্যার টীকাকার মুনিদত্তের টীকা বা ভাষ্যরচনা থেকে পাওয়া গ্রন্থটির শিরোনাম যথাক্রমে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' ও 'চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'।
১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য) চর্যাপদের পুঁথির সন্ধান পান।
নেপাল রাজদরবারে প্রাপ্ত সংকলিত গ্রন্থটির নাম ছিল 'চর্যাগীতিকোষ'। গ্রন্থের আবিষ্কর্তা শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর নতুন নামকরণ করেন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়।' 'চর্যাগীতি কোষ' গ্রন্থটি মূলতঃ টীকা বা ভাষ্য রচনা কেন্দ্রিক ব্যাখ্যামূলক একখানি পুঁথি । কিন্তু পুঁথিটির শেষের কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল বলে খণ্ডিত সেই পুঁথির টীকাকারের নাম জানা যায়নি।
■ চর্যার রচনা কাল:-
চর্যার রচনাকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। গ্রন্থটির আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গ্রন্থের ব্যাখাকর্তা ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতগণ চর্যাগীতি গুলিকে সাধারণ ভাবে দশম ও দ্বাদশ শতকের অন্তবর্তীকালের রচনা বলে মনে করেন।
■ চর্যার পদকর্তা ও পদসংখ্যা :-
চর্যাগীতিতে লুইপাদ, সরহপাদ, কাহ্নপাদ প্রভৃতি নামোপাধিযুক্ত ২৪ জন পদকর্তার ৫১ টি পদ সংকলিত হয়েছিল। তার মধ্যে সাড়ে ছেচল্লিশটিপদ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। চর্যাগীতিতে সংকলিত পদগুলির মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্নপাদ (পদসংখ্যা-১০টি) তারপরে ভুসুকুপাদ (পদসংখ্যা-৮) এবং সরহ বা সরহপাদ (পদ সংখ্যা-৪), বাকিপদ-কর্তাগণের কেউ তিনটি কেউ দুটি এবং কেউ একটি করে পদ রচনা করেন।
■ চর্যাপদের ভাষা :-
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাচার্য-বিনিশ্চয় গ্রন্থের ভূমিকায় মুনিদত্তের সংস্কৃত ধারাভাষ্যের উপর ভিত্তি করে চর্যাপদের শ্লোকের রহস্যময় ভাষাকে সান্ধ্যভাষা বা আলো-আঁধারি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী বেশ কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে প্রমাণের ভিত্তিতে পরে এই ভাষাকে 'ইচ্ছাকৃত ভাষা' (সংস্কৃত: সন্ধ্যা-ভাষা) হিসেবে উল্লেখ করেন। চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা।
■ ছন্দ ও অলংকার:-
চর্যার পদগুলি প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী পদে রচিত। এতে মাত্রাছন্দের প্রভাবও দেখা যায়। ১৬ মাত্রার পাদাকুলক ছন্দের ব্যবহারই এখানে বেশি। তবে সর্বত্র নির্দিষ্ট মাত্রারীতি দেখা যায়নি।
■ চর্যার সমাজচিত্র:-
চর্যাগীতিগুলির বেশির ভাগই রচিত হয়েছে বাংলা দেশ ও বাঙালি-জীবনের পটভূমিকায়। ফলে প্রাচীন বাংলা ও বাঙালিজীবনের নানা ঘটনাবলী উঠে এসেছে চর্যার গানে।
অবশ্য সেখানে বাস্তব জীবনের ছবিগুলি অধ্যাত্মসংগীতে এক একটা আবরণ বা রূপকের ছদ্মবেশ নিয়ে ধরা পড়েছে। ফলে দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা যেমন জীবনচর্যা, তাদের আচার-ব্যবহার রীতি-নীতি, হাস্য-পরিহাস, বৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনৈতিক-অবস্থান, দাম্পত্য জীবনের প্রেম-প্রীতি-অনুরাগ-বিরাগ, সংশয়, বিশ্বাস, আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি খুটিনাটির বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের ঐতিহাসিক দলিল রূপে 'চর্যাগীতি'গুলিকে গ্রহণ করা যায়।
■ চর্যার সাহিত্যমূল্য:-
চর্যাপদে বাস্তব অথচ কাব্যময় নিখুঁত দৃশ্য ছায়াছবির মতো পাঠকের মনের চোখের উপর দিয়ে ভেসে যায়। প্রকৃতি ও মানুষকে কত নিবিড় ভাবে চিনতে এবং ভালোবাসলে এই ছবিগুলি আঁকা যায় তা সহজেই অনুমেয়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন , "প্রতীক রূপকের সাহায্যে চিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানব চরিত্রের মধ্যে সুখ-দুঃখের বিরহ মিলনের দৈনন্দিন জীবন চিত্র চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীব করিয়াছে"।
● প্রকৃতি বর্ণনা: চর্যাপদের পদগুলির মধ্যে গভীর গূঢ় অর্থ থাকলেও তার বাইরের সাধারণ অর্থে প্রকৃতির নির্মল চিত্র ফুটে উঠেছে।
● আখ্যানধর্মীতা: আখ্যানধর্মীতা চর্যাপদের সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ। চর্যার কোনো কোনো পদে আখ্যান বা কাহিনির সন্ধান মেলে।
● ছন্দ ও অলংকার প্রয়োগ:- চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রমাণ করা গেলেও কিন্তু কাব্য বিচারে এই সমস্ত মাপকাঠিই সব নয়। সবচেয়ে বড়ো মাপ কাঠি পাঠকের অনুভূতি। যদি সেই অনুভূতিতে কোনো কাব্য নাড়া দিতে পারে তবে তার ভাষা ছন্দ অলঙ্কার প্রয়োগের অসম্পূর্ণতা থাকলেও তা-ই সত্যিকার কাব্য। ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারের দিকে চর্যাপদ নিশ্চয় ত্রুটি মুক্ত নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও চর্যাপদকে সুষ্ঠু সুন্দর কাব্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না, কারণ চর্যাপদে আছে সুগভীর মানবতাবোধের নির্মল অনুভূতি। চর্যাপদ সেই দিক দিয়ে অমূল্য সৃষ্টি।
■ উপসংহার:-
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করে বলা যায় যে বৌদ্ধ সাধন সংগীত হলেও চর্যাপদ আদর্শ সাহিত্য হয়ে উঠেছে। চর্যার ভাব ও রূপ সাহিত্য গুণের দিক থেকে উৎকৃষ্ট ছিল বলেই পরবর্তী সাহিত্যে তাঁর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল।
2. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কার কাল ও আবিষ্কারক কে ছিলেন ? এর সমাজ চিত্র আলোচনা করো ? শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রকৃতি আলোচনা করো ? 2+3+5 ***
Ans:- আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এই একটি মাত্র গ্রন্থ আবিষ্কার ও প্রকাশের পর নিস্তরঙ্গ বাংলা সাহিত্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল । দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধারণার মূলে আঘাত করেছিল এ কাব্যের আবিষ্কার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে চিন্তা-চেতনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য আবিষ্কারের ফলে।
■ আবিষ্কার কাল ও আবিষ্কারক:-
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুথিটি বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভ আবিষ্কার করেন ১৩১৬ বঙ্গাব্দে। তিনি বিষ্ণুপুরের কাছে কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মাচা থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিটি খুঁজে পান। পুঁথিটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'র আবিষ্কার কাল ১৩১৬ বঙ্গাব্দ। প্রকাশকাল এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
■ সমাজ চিত্র:-
■ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রকৃতি:-
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক কাব্য। গ্রন্থটি ১৩টি অংশে বিভক্ত- জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালিয়দমন খণ্ড, হারখণ্ড, যমুনাখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ।
জন্মখণ্ডে কৃষ্ণ-আবির্ভাবের পৌরাণিক ভূমিকা রচনা করা হয়েছে। কংসের পাপে পীড়িতা পৃথিবীর দুঃখমোচনের জন্য ভগবান নারায়ণ কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দানখণ্ডে কৃষ্ণ মথুরার পথে দানী সেজে বসল এবং পথের বকেয়া মাশুলের পরিবর্তে 'দানী' কৃষ্ণ রাধার যৌবন দাবী করল দান হিসেবে। বিরহখণ্ডে রাধার হৃদয়ের আর্তির মধ্যে অসম্পূর্ণ গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে।
নাটগীতিমূলক এই আখ্যায়িকাতে লৌকিক জীবনের সমাজচিত্র বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। গ্রন্থমধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, কুমার, তেলী, নাপিত, বৈদ্য, আচার্য, প্রভৃতি নানা জাতি-সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। ব্যবহারিক জীবনচর্যার দৈনন্দিন দিক থেকেও কবি বিভিন্ন উপাদন সংগ্রহ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে' সোনা, হীরা, মণি, মুক্তা ইত্যাদি রত্নের উল্লেখ-প্রাচুর্য সাধারণ লোকেরও সচ্ছল অবস্থার পরিচয় বহন করে । কবি গোয়ালিনী রাধাকেও নানা অলঙ্কারে সুসজ্জিতা করে তুলেছেন। এছাড়া সমকালীন লোকাচার ও লোকবিশ্বাস-এর পরিচয়ও পাওয়া যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে।
3. বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ভাগবত অনুবাদকের নাম কি? তাঁর অনুবাদকর্ম ও কবিত্ব প্রতিভার পরিচয় দাও। ** 1+4
অথবা,
মালাধর বসুর কবিপ্রতিভা আলোচনা করো । 5
অথবা,
শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের সম্পর্কে আলোচনা করো। 5
উ:- বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ভাগবত অনুবাদক হলেন মালাধর বসু।
পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি (প্রাক-চৈতন্যযুগের কবি) মালাধর বসু তার জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কুলিন গ্রামে। পিতা—ভগীরথ বসু, মাতা—ইন্দুমতী। কাব্যের শুরুতে কবি আত্মপরিচয় দিয়ে লেখেন-
"বাপ ভগিরথ মোর মা ইন্দুমতি।
জার পুজো হেল মোর তারা অনে মতি।"
‘শ্রীকৃষ্ণবিজয় ভাগবত পুরাণের অনুবাদক হলেন মালাধর বসু। ভাগবতে দশম ও একাদশ স্কন্ধের অনুবাদে শ্রীকৃষ্ণের জীবনমাহাত্ম বর্ণিত হয়েছে যেখানে বারোটি স্কন্ধে বিভক্ত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব কৃদাসকবিরাজ বিরচিত শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে মালাধর বসুর শ্ৰীকৃবিজয় কাব্যের বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন।
■ শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য :-
শ্ৰীকৃবিজয়' কাব্যের রচনাকাল পঞ্চদশ শতাব্দী। কবির কথায় ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্য শুরু করেন এবং ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ করেন।এতে কাব্যটির রচনাকাল বিষয়ক একটি শ্লোক আছে, তা হল-
" তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরগুল।
চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন।।"
শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যটি 'শ্রীকৃষ্ণবিক্রম', ‘গোবিন্দ বিজয়’ ও ‘গোবিন্দ মঙ্গল' নামেও পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণবিজয় তিনটি পর্বে বিভক্ত। আদ্য কাহিনি, মধ্য কাহিনি, অন্তু কাহিনি। মালাধর বসু ভাগবতের কাহিনির বাঙালি রুচিসম্মত সুক্ষ্ম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় শক্তিবৃদ্ধি ও বাঙালির রসানুভূতিকে দৃঢ় করে গেছেন। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণুবিজয়' কাব্যটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। চৈত্যচরিতামৃতম-এ উল্লেখ আছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাবাটির প্রশংসা করে বলেছেন-
" গুণরাজ খান কৈল 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়'।
তাঁহা এক বাক্য তাঁর আছে প্রেময়।।
জন্দের অন্দর কৃষ্ণ চোর প্রাণনাখ।
এই বাক্যে বিকাইন্তু তাঁর বংশের হাত।"
শ্রীকৃষ্ণবিজয়' কাব্যে বাংলাদেশ ও বাঙালি জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় - বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বারকার চিত্র অঙ্কনের মধ্যে বাঙালি মনোভাব ও বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, বিভিন্ন ফলমূল, ছায়া সুশীতল এবং সৌরভপূর্ণ লাবণ্যময়ী বাংলাদেশের কথাই রসঘন হয়ে উঠেছে। কবিত্ব শক্তির অভাব থাকা সত্ত্বেও 'শ্ৰীকৃবিজয় কাব্যটি বৈষ্ণব সমাজে সমাদৃত হয়েছিল কারণ—(ক) শ্রীকৃষ্ণবিজয় ভাগবতের অনুবাদ।
‘মধ্যযুগে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ বাংলা সাহিত্যকে পূর্ণতর মর্যাদা দিয়েছে।একথা বলার কারণ - প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার,বৌদ্ধযুগের অবসানে যে পৌরাণিক আদর্শ হিন্দুসমাজ ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল, তার প্রভাবে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সমাজ বিশেষভাবে নতুন রূপ লাভ করেছে। অনুবাদ সাহিত্যে তার স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। বস্তুত, এই অনুবাদগুলি না পাওয়া গেলে বাংলা সাহিত্য কোনোদিন ক্লাসিক মহিমা লাভ করতে পারত না।
4. অনুবাদক হিসাবে কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো। * 5
উ:- বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের জগতে কৃত্তিবাস ওঝা স্মরনীয়। তিনি মূলত বাল্মিকির রামায়নের শ্রেষ্ট বাংলা অনুবাদক। তার রচিত রামায়ণের নাম হল শ্রী রামপাচালী।
■ প্রাথমিক জীবন:
কৃত্তিবাস ওঝা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩১ সালে অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে । তার পিতা ছিলেন বনমালী ওঝা। এবং পিতামহ মুরারি ওঝা ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত।
■ কৃত্তিবাসী রামায়ণ:-
কৃত্তিবাসী রামায়ণ মূলত বাল্মিকী রামায়ণের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও, কৃত্তিবাস এই মহাকাব্য বাংলা নিজস্ব ভাবধারা ও স্থানীয় সংস্কৃতি সংযোজন করেছেন। তার লেখনীতে বাংলার গ্রামের ছবি, বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং তাদের আচার-আচরণের প্রতিফলন ঘটেছে। তাইতো আর রামায়ণ কাব্য বাংলা ভাষা মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে।
■ কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভাষা ও শৈলী:-
কৃত্তিবাসী রামায়ণের ভাষা ছিল সহজ, প্রাঞ্জল অসাধারণ মানুষের বোধগমা। তিনি সংস্কৃতের জটিলতা থেকে দূরে থেকে সরল বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন। তার অনুবাদ কাজ বাংলা ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলার গ্রামাঞ্চলের কৃত্তিবাসী রামায়ণের আসর বসতে শুরু করে। যেখানে মানুষ এই মহাকাব্য পাঠ করে শোনাতেন।
■ কৃত্তিবাসের মৌলিকতা:-
কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার হৃদয়ের ভাষা ও প্রাণের আকুতি। সংস্কৃত রামায়ণের কাহিনী, প্রেক্ষাপট ও চরিত্রগুলি অবিকৃত রেখে কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালির জীবনধর্মকে মন্ডিত করে ফেলেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ছায়াপাত ঘটেছে। রাম লক্ষণের ভাতৃত্ব, সীতার দুঃখময় বধূজীবন, হনুমানের দাস্যভক্তি, সুগ্রীব বিভীষনের দাস্যভক্তি, বাঙালির ঘরের জিনিস হয়ে উঠেছে।
■ কৃত্তিবাসী রামায়ণ এর বৈশিষ্ট্য:-
বাঙালি ও বাংলার কবি কৃত্তিবাস বাল্মিকৃত সংস্কৃত রামায়ণের কাঠামোর মধ্যে নিজের কবি কল্পনাকে মূর্ত করে বাঙালির মন দিয়ে বাঙালির মতো রামায়ণ রচনা করেছেন। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য বাঙালির বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কৃত্তিবাসী স্বরূপে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের পরিচিত জীবন থেকে লৌকিক উপমা রূপক কাজী ব্যবহার করে কৃত্তিবাসী বক্তব্যকে খুবই তির্যক ও তীক্ষ করে তুলেছেন। অলংকার প্রয়োগে কবির কৃতিত্ব এই যে সংস্কৃত অলংকারের সঙ্গে দৈনন্দিন বাঙালির জীবন স্থান পেয়েছে। ফলে কৃত্তিবাসী সৃজনশীল প্রতিভা ফুটে হয়ে উঠেছে।
5. মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কাশীরাম দাসের অনুবাদকর্মের পরিচয় দাও। * 5
উ:-■ কাশীরাম দাসের ভারত পাঁচালী:-
মধুসূদন দত্ত কাশীরাম দাস সম্পর্কে বলেছিলেন- "হে কাশী কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।" কথিত আছে কাশীরাম মেদিনীপুরের জমিদারের আশ্রয়ে থেকে পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন। সেসময় রাজবাড়িতে যে সমস্ত কথক এবং পুরাণ পাঠকারি পণ্ডিত আসতেন, তাদের মুখ থেকে মহাভারত প্রসঙ্গ শুনে তাঁর মহাভারতের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। এই অনুরাগের ফলেই তিনি মহাভারতের অনুবাদ শুরু করেন। কাশীরামের লেখা মহাভারতের অনুবাদ গ্রন্থটির নাম 'ভারত পাঁচালী'। এটি সম্ভবত তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রচনা করেন
কাশীরাম দাস মহাভারতের অনুবাদ করলেও তিনি মহাভারতের প্রথম অনুবাদক নন। তুর্কি আক্রমণোত্তর কালে উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন সংস্কৃতে লেখা পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থগুলির অনুবাদ শুরু হয়, মহাভারতের অনুবাদও তখনই শুরু হয়। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক হিসাবে কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে ধরা হয়। তবে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসাবে কাশীরাম দাসই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।
■ কাশীরাম দাসের কবি প্রতিভা:-
কাশীরাম দামের কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই বলেন যে, তিনি মহাভারতের সম্পূর্ণ অনুবাদ করতে পারেননি। আদি, সভা, বন ও বিরাট-এই চারটি পর্ব অনুবাদ করেন। বাকি অংশটুকু তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র নন্দরাম সমাপ্ত করেন। সমালোচকদের এই অনুমানের পিছনে একটি কারণ হল কাশীরাম দাম তার অনুবাদে নিজেই লিখেছেন- " আদি, সভা, বল, বিরাটের কতদুর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।"
যাইহোক কাশীরাম দাস মহাভারতের সম্পূর্ণ অণুবাদ করুন আর না করুন শুধুমাত্র এই চারটি পর্বের অনুবাদ বিচার করলেও তার কবি কৃতিত্ব ছোট করা যায় না। কাশীরাম দাস সংস্কৃত মহাভারতের হুবহ অনুবাদ করেননি, তিনি মহাভারতের ভাবানুবাদ করেছেন।
কাশীরামের অনুবাদটি পড়লে কখনোই মনে হয় না যে, তিনি সংস্কৃত জানতেন না। হয়তো শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য। তিনি কিছু কিছু জায়গায় মহাভারতের সংস্কৃত শ্লোক যেভাবে বাংলায় রূপান্তরিত করেছেন তা লক্ষ করলে তাঁকে সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত বললেও কম বলা হয়।
কাশীরাম দাস চৈতন্যোত্তর যুগের কবি ছিলেন এবং নিজেও বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর রচনার ভাব ও ভাষায় চৈতন্যদেবের একটা প্রভাব পড়েছিল। তিনি তাঁর রচনায় মূল মহাভারতের রুক্ষ্মতা, শুষ্কতা, বৈরিতা অনেকটাই কমিয়ে এলেছিলেন।
কাশিরামের অনুবাদ গ্রন্থে বাঙালিয়ানার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, লড়াই-সংঘাত। তবুও কাশীরাম যে তাঁর রচনাটি বাঙালির উপযোগী করে লিখেছিলেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর হয়ত এই কারণেই আজও মহাভারতের কথা মনে পড়লে সবার আগে স্মরণে আমে কাশীরাম দামের সেই বিখ্যাত শ্লোক-
" মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।"
দীনেশচন্দ্র সেন মহাভারতের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- "এক একখানি পত্র এক একটি চমৎকার চিত্রপটের ন্যায়, পড়িতে পড়িতে জগৎপুঞ্জ, যুদ্ধবীর ও প্রেমিকগণের মূর্তি মানসভক্ষের সমক্ষে উদঘাটিত হয়।
6. বৈষ্ণব পদাবলী বলতে কী বোঝ? এর বিষয়বস্তু কী? **
উ:- ■ বৈষ্ণব পদাবলী :-
বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা-সাহিত্যের এক মহামূল্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য একটি বিস্তৃত কালপর্ব জুড়ে বিন্যস্ত। 'বৈষ্ণব' অর্থাৎ বিষ্ণু যাদের উপাস্য দেবতা, আর 'পদাবলী' হল পদ সমষ্টি বা গানের সমষ্টি। প্রাক-চৈতন্যযুগে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য ও চৈতন্য পরবর্তী যুগে গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস বিশেষভাবে খ্যাতিমান হলেও আরও বহু কবি বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত পদ লিখেছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল বিষয়বস্তু হল কৃষ্ণের লীলা এবং মূলত মাধুর্যলীলা। রাধাকৃষ্ণলীলাকথাই প্রধানত পদাবলীর মূল বিষয়বস্তু। রাধা-কৃষ্ণ প্রাসঙ্গিক কথাকে নানা পর্যায়ে বিভক্ত করে পদকর্তারা বিভিন্ন পদ রচনা করেছেন এবং তাঁদের বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন।
■ বিষয়বস্তু:-
(a) কৃষ্ণ তত্ব:-
বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান পুরুষ বা পরমপুরুষ হলেন কৃষ্ণ। তিনি আবার সমস্ত বৈষ্ণবের কাছে প্রধান আরাধ্য দেবতাও অর্থাৎ পরমব্রহ্ম ভগবান। উপনিষদের ব্রহ্ম ও পুরাণের বিষ্ণুর মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। তাঁদের কাছে শঙ্খ-চক্র-গদাধারী শ্রীবিষ্ণু আরাধ্য মূর্তি নয়; বরং আরাধ্য দেবতা হলেন বংশীধারী নন্দদুলাল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের ৪র্থ পরিচ্ছেদে বলেছেন,
'পূর্ণ ভগবান অবতারে যেই কালে।
আর সব অবতার তাঁতে আসি মিলে।'
(b) শ্রীরাধাতত্ত্ব:-
বৈষ্ণবধর্মে ও সাহিত্যে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের মতো রাধা ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। বৈষ্ণব দর্শনে শ্রীকৃষ্ণ নানান লীলাশক্তির অধিকারী। কৃষ্ণের এই শক্তিকে কোথাও কোথাও তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে-স্বরূপ শক্তি, তটস্থা বা জীবশক্তি ও মায়াশক্তি। রাধার এই রূপ ও তত্ত্বের প্রকাশ বিকশিত হয়ে ওঠে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের পরে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাধার ভাব ও কান্তি নিজ অঙ্গে ধারণ করেই। কৃষ্ণদাস বলেছেন,
"কৃষ্ণ বলে নাচে কাঁদে হাসে অনুক্ষণ।
যারে দেখে তারে কহে কহ কৃষ্ণনাম।'
(c) গোপীতত্ত্ব:-
হরিবংশের পরে রচিত ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণে গোপীগণের উল্লেখ আছে। সেখানে রাধার কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ না থাকলেও প্রধান এক সখীর সঙ্গে কৃষ্ণের রাসলীলার কথা উল্লিখিত আছে। হরিবংশেও গোপীদের কথা আছে যে, তারা সংসার বন্ধন তুচ্ছ করে জীবনকে মধুর করে উপভোগ করবার জন্যে কান্তার সঙ্গে মিলিত হোত। তারাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার সহায়িকা। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার লীলা দর্শনই তাদের একমাত্র কাম্য বস্তু। আবার এই গোপী বা সখীহীনা রাধা অসম্পূর্ণা। 5. বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর অবস্থান নির্ণয় করো।
7. বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণ নির্দেশ করো। **
উ:- ■ বিদ্যাপতি:-
বিদ্যাপতি বাঙালী ছিলেন না, বাংলা ভাষায় তাঁর কোন রচনা নেই, তবু, মিথিলার এই প্রতিভাময় কবি বাংলা সাহিত্যে যেমন অনায়াসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন তেমনি ভারতীয় সাহিত্যে 'কবি সার্বভৌম' রূপে অভিহিত হয়েছেন। তিনি শৈব ধর্মে দীক্ষিত হয়েও বৈষ্ণব কবিতা রচনায় যেমন অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি পাশাপাশি রচনা করেছেন প্রাকৃত-অবহট্ঠ ও সংস্কৃত ভাষায় জীবনীকাব্য এবং পুরাণ গ্রন্থাদি। বিদ্যাপতি-রচিত বিভিন্ন গ্রন্থগুলি হলো কীর্তিলতা , ভূপরিক্রমা, পুরুষ পরিক্রমা , কীর্তিপতাকা ইত্যাদি।
■ বিদ্যাপতির বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কারণ :-
বিদ্যাপতি বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ না করলেও, বাংলায় পদরচনা না করলেও বাঙালীর হৃদয়ে সমাসীন হয়েছেন কবি। তাঁর পদাবলী বাঙালীর হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদাবলী আস্বাদন করে পরম আনন্দ লাভ করতেন
'চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূপ রামানন্দ সনে
মহাপ্রভু রাত্রিদিনে
গায় শুনে পরম আনন্দ।'
বিদ্যাপতির পদে প্রেমের, মধুর রসের বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে। বৈষ্ণবীয় 'কান্তাপ্রেম'-এর সমৃদ্ধ কাব্যরূপ বিদ্যাপতিকে অমরত্ব দিয়েছে। মিথিলা বিদ্যাপতির জন্মস্থান হলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তরা তাঁর পদে তাঁদের সাধনার বিষয় খুঁজে পেয়েছিলেন বিশেষ ভাবেই।
বিদ্যাপতি বাংলায় পদ রচনা না করলেও বাঞ্জলীর হৃদয়ে সমাসীন হয়েছেন। তাঁর পদাবলী বাঙালীর হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদাবলী আস্বাদন করে পরম আনন্দ লাভকরতেন। বাংলা ও মিথিলা এই দুই স্থানের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক সুসম্পক স্থাপিত হওয়ার কারণে মৈথিল ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার, আসামের ছাত্রদের ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার সংযুক্তি ঘটে। 'মৈথিল' ভাষায় বৈষ্ণব কবিতা রচনা করে বাঙালী তথা বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতি অর্ন্তভুক্ত হয়ে গেছেন।
8. 'পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস' - আলোচনা করো। **
উ:- প্রাক-চৈতন্যযুগেই নয়- মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যে চণ্ডীদাস একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত। সহজ-সরল ভাষায়, প্রেমের আনন্দ মধুর বেদনাকে, রস সমৃদ্ধ করেছেন কবি চণ্ডীদাস। জনশ্রুতি অনুসারে বীরভূম জেলার নায়ুর গ্রামে চণ্ডীদাস বাস করতেন।চন্ডীদাস 'পূর্বরাগ ও আক্ষেপানুরাগ'-এর শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর প্রতিভার প্রকাশ এই সব পর্যায়ের পদেই।
চণ্ডীদাসের পদাবলীর মধ্যে পূর্বরাগ পর্যায়ের পদগুলি যেমন আক্ষেপানুরাগের প্রকাশ ঘটে। নিজের বিরূপ ভাগ্য তার এই দুঃখের কারণ তাই, আপাত ভাবে যেসব বিষয়াদি জীবন নির্বাহের পক্ষে অনুকূল সেই গুলিই রাধিকার কাছে বিরূপ হয়ে প্রতিভাত হয়েছে-
অবিস্মরণীয় করে রাধার চন্ডীদাস রাধিকাকে বিরহিনী রূপেই প্রভাসিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- 'বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি।'
"যমুনার জলে যাঞা যদি দিই ঝাঁপ।
পরাণ জুড়াবে কি অধিক উঠে তাপ।।
অতএব এ ছার পরাণ যাবে কিসে।
নিচয়ে ভখিমু মুঞি এ গরল বিষে।।"
■ চণ্ডীদাসের পদাবলীর বৈশিষ্ট্য:-
চন্ডীদাস প্রেমের কবি, তাঁর কবিতা প্রেমের কবিতা। যে প্রেমে আত্মানুভূতি প্রবল, আত্মনিবেদন মুখ্য সেই প্রেমের ব্যাকুলতা ও আবেগ আরো গভীর মর্মস্পর্শী ভাবে তিনি চিত্রিত করেছেন।
চণ্ডীদাসের সরল সহজ ভাষা সত্যিই শ্রোতার মন হরণ করে নেয়। চণ্ডীদাস যে ভাবের কবি তা তাঁর পদাবলী পড়তে পড়তেই বোঝা যায়।
তিলে তিলে আইসে যায়।
ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার
মন উচাটন নিশ্বাস সঘন
কদম্ব কাননে চায়।
সবশেষে চণ্ডীদাসের কবিতার ভাষার কথা। এ ব্যাপারে রবীন্দ্র-উক্তিই যথেষ্ট "আমাদের চণ্ডীদাস সহজ ভাষার সহজ কবি, এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি। তিনি একছত্র লেখেন ও দশছত্র পাঠককে দিয়া লেখাইয়া লন।"
9. রোম্যান্টিক কবি জ্ঞানদাসের পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করো। **
উ:- চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি-জ্ঞানদাস। তিনি দীক্ষিত বৈষ্ণব কবি; নিত্যানন্দ জাহ্নবাদেবী তাঁর দীক্ষাগুরু। তিনি ভক্ত কিন্তু রোমান্টিক মনের অধিকারী।কাটোয়ার কাছে কাঁদড়া গ্রামে আনুমানিক ১৫৩০ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করেন। চন্ডীদাসের মতো জ্ঞানদাসও ছিলেন রোমান্টিক কবি। তিনি ষোল শতকের পদাবলী সাহিত্যের একজন সেরা কবি। তার সুনাম চন্ডীদাস বা বিদ্যাপতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
■ জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা:-
রোম্যান্টিক কবি জ্ঞানদাস এর কবিতায় কৃষ্ণ রূপের বন্দনা এত অপূর্বভাবে ফুটে উঠেছে-
" রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।। "
জ্ঞানদাস একজন উৎকৃষ্ট পদাকার ছিলেন। তার কিছু স্মরনীয় পদ আছে। যেমন, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর, কিংবা সুখের লাগিয়ে এ ঘর বান্ধিলুঁ ইত্যাদি। এই সব পদ বৈষ্ণব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। পদাবলীর গুণ ও মান বৃদ্ধিতে জ্ঞানদাসের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ষোল শতক পদাবলীর স্বর্ণযুগ। জ্ঞানদাস এই স্বর্ণযুগের কবি। ভক্তের অনুভূতিকে কবিতায় প্রকাশ করার অপূর্ব প্রতিভা তার মধ্যে ছিল।
শব্দব্যবহার ও ভাষাভঙ্গি একই রকম বলে জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের অনুসারী বলা হয়। অকৃত্রিম সহজ রচনারীতির দিক থেকে চন্ডীদাসের সঙ্গে তার মিল অবশ্যই আছে। কিন্তু জ্ঞানদাস একজন সতন্ত্র কবি। আধুনিক কালের গীতিকবিতার বৈশিষ্ট তার পদে পাওয়া যাবে।
জ্ঞানদাসের নামে প্রায় শ'দুয়েক পদ চালু আছে। ব্রজবুলিতেও তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন। তবে তার বাংলা পদগুলো ব্রজবুলির পদের তুলনায় অনেক ভাল। তবে রুুপানুরাগের পর্যায়ের পদ গুলোই জ্ঞানদাসের কলমে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। দুটো রুুপানুরাগের পর্যায়ের পদ হল--
“রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।
ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরান
জ্ঞানদাস সঙ্গীত বিষয়েও একজন বিশেষজ্ঞ। একালে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যেমন নিজেদের লেখার গানে সুর দিয়েছেন, সেকালে জ্ঞানদাসও একই কাজ করেছেন। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে জ্ঞানদাস বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি গান লিখে সুর দিয়েছেন।
10. 'গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।' কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ** অথবা, গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলা হয় কেন ?
উ:- গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য ছিলেন– কথাটি বহুল প্রচলিত । একে তো তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে পরিচিত ছিলেন, তার ওপর আবার বিদ্যাপতির সঙ্গে ভণিতায়ও তার নাম বহুবার উচ্চারিত হয়েছে । বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের কাব্যের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
তিনি যে সজ্ঞানে বিদ্যাপতির অনুসরণ করেছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এই কারণেই উভয়ের রচনায় ভাবগত ঐক্যও বর্তমান। “এঁদের কাব্যে ভাব এবং রীতির মধ্যে ব্যবধান তেমন দেখা যায় না । উভয় কবিই বস্তুতে বিভোর হয়েছেন ফলে এঁদের কাব্যের সর্বত্রই ভাবের সাথে রূপের, শিল্পের সাথে শিল্পীর, মনের সাথে মননের একটি ব্যবধান রয়ে গেছে। বিদ্যাপতির মতোই তিনিও কাব্যের বহিরঙ্গের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
অবিমিশ্র ব্রজবুলি ভাষা, ছন্দের বৈচিত্র্য, অলঙ্কারের বহুল ব্যবহার ইত্যাদিতে বিদ্যাপতির অনুসরণপ্রিয়তাই লক্ষ্য করা যায়। এমনকি তিনিও বিদ্যাপতির মতোই কৃষ্ণলীলাকাহিনীর দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন।
বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস উভয়েই সচেতন শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও কাব্যকলাপ্রয়োগের কতকগুলি বিশেষ দিকে গোবিন্দদাস উৎকৃষ্টতর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছন্দোবৈচিত্র্য, অলঙ্করণ ইত্যাদি।
ভাবোল্লাস ও প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতি সমধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু অভিসারের পদে গোবিন্দদাস তাঁকে অতিক্রম করে গেছেন। গৌরচন্দ্রিকার পদ-রচনায় গোবিন্দদাস ভাবোচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে কাব্যের বহিরঙ্গ-গঠনে সংযত কবি-কল্পনার পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্যাপতির অবশ্য গৌরচন্দ্রিকা রচনার কোনো সুযোগই ছিল না।
গোবিন্দদাসের কাব্যে যে একটা অপূর্ব গীতি-মূর্ছনা লক্ষ করা যায়, তেমনটা বিদ্যাপতির ছন্দ-সুষমাযুক্ত পদেও পাওয়া যায় না। গোবিন্দদাসের কাব্যে যে সুরের সম্পূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়, বিদ্যাপতির কাব্যে ছন্দ-ধ্বনি-অলঙ্কার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সুরের মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাক থেকে যায়। বাক্যজালের জটিলতায় জড়িয়ে বিদ্যাপতির কাব্য যেখানে নীরস বলে প্রতিভাত হয়, গোবিন্দদাসের নিটোল কাব্য সেখানে রসে টই-টুম্বর। “বিদ্যাপতির নিকট গোবিন্দদাসের ঋণ ছন্দের জন্য, সুরের জন্য নয়।
মিলনের পদ-রচনায় বিদ্যাপতির দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন রূপের, জীবনভোগের কবি, তাই তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায় যৌবনের উচ্ছ্বাস ও প্রেমের নৃত্য। মিলনের মতোই বিরহের পদ রচনাতেও বিদ্যাপতি ছিলেন অধিকতর সার্থক। ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’ কিংবা ‘শুন ভেল নগরী। শুন ভেল দশ দিশ, শুন ভেল সগরি। প্রভৃতি পদের কাব্যসৌন্দর্য ভাবগভীরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদ্যাপতিকে অসাধারণ কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এইক্ষেত্রে গোবিন্দদাস অনেকটাই ব্যর্থ। ভাষার ঐশ্বর্য আর ছন্দ ঝঙ্কারের মধ্য দিয়ে শ্রীমতীর আর্তি যথাযথভাবে ফুটে উঠবার অবকাশ পায়নি।
11. যুগবিভাগ বলতে কী বোঝানো হয়ে থাকে? যুগবিভাগের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। 2+3
উ:- ■ বাংলা সাহিত্যে যুগ বিভাজন :-
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছর বা তার কিছু অধিক সময়ের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের এই হাজার বছরের অধিক কালের ইতিহাস কে মনে রাখার সুবিধার্থে বা কালের প্রবাহ কে স্বীকার করে নিয়ে কয়েকটি যুগ বা প্রর্যায়ে ভাগ করে নিতে পারি। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সাল তারিখের হিসেব স্পষ্ট যুগ বিভাগ করা যায় না। সাল তারিখ দেখে যুগের আরম্ভ হয় না, যুগের পরিসমাপ্তিও ঘটেনা। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।
■ যুগ বিভাজনের পর্যায় :-
বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ নির্ধারিত হয়েছে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কে প্রধানতঃ তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে।
১। প্রাচীন যুগ বা আদিযুগ (৭৫০-১২০০) ,
২।মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০) ও
৩।আধুনিক যুগ (১৮০১- বর্তমান সময় পর্যন্ত) ।
প্রাচীন যুগ :
ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আদি মধ্য যুগের প্রাচীনতম ও একমাত্র গ্রন্থ হল "চর্যাপদ"।
মধ্য যুগ :
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের বিস্তার ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মধ্য যুগকে আবার দুটি উপবিভাগে ভাগ করা হয় যথা- আদি মধ্যযুগ(১৩০১-১৫০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১ - ১৮০০)। আদি মধ্য যুগের সাহিত্যিক নিদর্শন গুলির মধ্য প্রথমের উল্লেখ করা যায় বড়ু চণ্ডীদাসের "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন"। এছাড়াও কৃত্তিবাসের "রামায়ণ", মালাধর বসুর "শ্রীকৃষ্ণবিজয়" বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গল কাব্য প্রভৃতি আদি মধ্যযুগের নিদর্শন। অন্ত মধ্যযুগের সাহিত্যিক নিদর্শন গুলি হল মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল, বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ, ভারতচন্দ্রের অন্নদা মঙ্গল ইত্যাদি।
আধুনিক যুগ:
আধুনিক যুগ বলে বাংলা সাহিত্যে স্পষ্ট যুগবিভাগ নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। তা হলেও মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন।
12. বাংলা ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করো। *** 5
উ:- খ্রিস্টীয় হাজার সালের পূর্বেকার বাংলা ভাষার কোন নিদর্শন না থাকায় বাংলা ভাষার উৎস খোঁজা কঠিন তবে এতটুকু জানা গেছে আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার অন্যতম হলো বাংলা ভাষা। সংস্কৃতির সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে কিন্তু তা প্রত্যক্ষ নয়। sanskrit হল ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের প্রাচীন ভাষা। বাংলা ভাষা উদ্ভবের সূত্র পৃথিবীর ভাষা বংশের নিহিত। ভাষার সাদৃশ্য বিচারে পৃথিবীর প্রায় 4000 ভাষাকে বারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানএর মধ্যে প্রধান ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ।
ইউরোপ ও এশিয়ার বহু ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে এসেছে । ক্রমবিবর্তনের পথে বাংলা ভাষার জন্ম এই উন্নত বংশে। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দুটি গুচ্ছ :- ১. সত্যম ২. কেন্তুম। সত্যম গুচ্ছের একটি ভাষা ইন্দো-ইরানীয়। এই ইন্দো-ইরানীয় শাখা ভারতের সিন্ধু উপকূলে প্রবেশ করে প্রায় 2000 বছর আগে। ভারতে প্রবেশকারী শাখা ভারতীয় আর্য নামে পরিচিত হয় । খ্রিস্টের জন্মের আগে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তৃতি ও বিবর্তন চলে। এই বিবর্তনের তিনটি ভাগ :-
১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য, ২. মধ্য ভারতীয় আর্য ৩. আধুনিক ভারতীয় আর্য।
১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য:- এই ভাষার সময়কাল পনেরশো ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দদ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এই ভাষার প্রধান সাহিত্যিক কৃতি হল বেদ। ঋক বেদ এগুলির মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ। বেদের ভাষা বৈদিক ভাষা নামে পরিচিত। এই বৈদিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে সংস্কৃত ভাষার দুটি রূপ সেই সময় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একটি হল সাহিত্যিক অপরটি হল কথ্য।
২. মধ্য ভারতীয় আর্য :- 600 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 900 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে লৌকিক বা কথ্য সংস্কৃত রূপান্তরিত হয়েছিল প্রকৃত তথা মধ্য ভারতীয় আর্য। এই সময়কার ভাষা পালি ভাষা নামে পরিচিত । অশোকের অনুশাসনের শিলালিপি এই ভাষায় নিদর্শন আছে। একসময় বিবর্তনের পথে প্রাকৃত ভাষা অপভ্রংশ ও অবহট্টের পরিবর্তিত হয়। এই অপভ্রংশের তিনটি স্তর :- ১. শৌর শ্রেণী ২. মহারাষ্ট্রীয় ৩. মাগধি। অনেকে বলে থাকেন এই মাগধী অপভ্রংশ বাংলা ভাষার উদ্ভব এর উৎস।
৩. আধুনিক ভারতীয় আর্য :- 900 খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই ভাষান্তরের ব্যাপ্তি। বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে মোটামুটি 10 শতকে হিন্দি ,বাংলা, গুজরাটি ,মারাঠি প্রভৃতি ভাষার জন্ম। এর সবই আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার নিদর্শন। এক সময় অপভ্রংশের ও অবহট্টের বিবর্তন প্রাচীন বাংলা ভাষার সৃষ্টি করে। এই প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন চর্যাপদ।
15. বঙ্গলিপির উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করো।* 5
উ:- ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম লিপির সন্ধান পাওয়া যায় অশোকের বিভিন্ন অনুশাসনে। অশোকের অনুশাসনে দু-প্রকার লিপি পাওয়া যায় – ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী। লিপি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আরামীয় লিপি থেকে ভারতের আদিলিপি ব্ৰাহ্মী ও খরোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। খরোষ্ঠী লেখা হত ডান থেকে বাম দিকে এবং ব্রাহ্মী লেখা হত বাম থেকে ডান দিকে। অবশ্য ডান থেকে বাম দিকে লেখার নিদর্শনও রয়েছে। ব্রাহ্মী থেকে আধুনিক নাগরী, বাংলা প্রভৃতি ভারতীয় লিপির জন্ম হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে ব্রাহ্মী লিপির দুটি আঞ্চলিক রূপ গড়ে ওঠে – উত্তর ভারতীয় রূপ এবং দক্ষিণ ও বহির্ভারতীয় রূপ। এর দ্বিতীয় রূপটি থেকে পল্লব লিপির উদ্ভব হয়, যার থেকে গ্রন্থি, মালয়ালম, তামিল, তেলুগু, কন্নড় ও সিংহলি লিপির জন্ম হয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় রূপই হল কুষাণ লিপি। চতুর্থ শতাব্দীতে অর্থাৎ গুপ্তরাজাদের শাসনকালে কুষাণ লিপি বিবর্তিত হয়ে গুপ্ত লিপি নাম ধারণ করে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত লিপি থেকে ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপির জন্ম হয়। সপ্তম শতাব্দীতে এই সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকেই কুটিল লিপি উদ্ভূত হয়।
এই কুটিল লিপি অষ্টম শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই পাঁচটি শাখার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারত শাখা বা শারদা লিপি থেকে তিব্বতি, কাশ্মীরি ও গুরুমুখি লিপি; উত্তর ও মধ্যভারত শাখা থেকে দেবনাগরী, কায়থী ও গুজরাটি লিপি; মধ্য এশিয়া শাখা থেকে খােটানি লিপি এবং যবদ্বীপ-বালিদ্বীপ শাখা থেকে যবদ্বীপীয় কুটিল লিপি উদ্ভূত হয়।
কুটিল লিপির পঞ্চম শাখা বা পূর্ব-ভারত শাখার লিপি হল প্রত্ন বাংলা লিপি বা গৌড়ীয় লিপি। নবম শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের রাজা নারায়ণ পালের তাম্রশাসনে এই লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এই প্রত্ন বাংলা লিপি থেকে নেপালি, ওড়িয়া, মৈথিলি, বঙ্গলিপি – এই চার প্রকার লিপি উদ্ভূত হয়েছে। এইভাবেই ব্রাহ্মী লিপি থেকে ক্রমে ক্রমে বঙ্গলিপি বা বাংলা লিপির উদ্ভব হয়েছে।